ছোট্ট অহনাতে পড়ে আছে মায়ের মন

ঘরে থাকলে মায়ের ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকত ছোট্ট অহনা। মা দুই সপ্তাহ ধরে করোনা আক্রান্ত হয়ে একটি কক্ষে বন্দী। তাই এভাবে দূর থেকে মায়ের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে সে। আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম, ৮ মে।
ছবি: সৌরভ দাশ

অহনার মুখে বোল ফুটেছে আগেই। মায়ের কাছে তিন বছরের মেয়ের মনে এখন অনেক প্রশ্ন, ‍‘বাসায় সারাক্ষণ মাস্ক পরে আছো কেন? দূরে দূরে থাকছ কেন? কোলে নিচ্ছো না কেন? অফিস যাচ্ছো না, আমাকে আদর করছ না কেন? তোমার কী হয়েছে...।’

ভুলিয়ে–ভালিয়ে মেয়ের কথার জবাব দিতে হচ্ছে চিকিৎসক অনিন্দিতা লোধকে।

বোয়ালখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এই চিকিৎসা কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হয়ে এখন বাসার একটি কক্ষে কার্যত বন্দী। বাসায় সারাক্ষণ ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকা একমাত্র মেয়েটিও তার প্রতি অবহেলা থেকে আঁচ করছে, কিছু একটা হয়েছে। তার সময়টা কাটছে না। মায়েরও ভালো লাগছে না মেয়েকে ছাড়া।

অনিন্দিতা বললেন, ‘কতক্ষণ আর দূরে রাখা যায় ছোট শিশুকে। ভালোভাবে মাস্ক লাগিয়ে পাশে এনে কথা বলি। প্রশ্নের জবাব দিই। একসময় বলেছি, আমার করোনা হয়েছে। তবু অহনা কী বুঝতে চায়।’

নগরের আন্দরকিল্লার বাসিন্দা অনিন্দিতার কোভিড-১৯ ধরা পড়েছে গত ২৪ এপ্রিল। একই দিন তাঁর শ্বশুর-শাশুড়িরও করোনা শনাক্ত হয়। স্বামী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক অঞ্জন বল আপাতত রক্ষা পেয়েছেন। বাবা-মায়ের শারীরিক অন্য জটিলতা থাকায় তাঁদের নিয়ে তিনি নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চলে যান।

বাসায় অনিন্দিতা আর মেয়ে অহনা। অহনার সঙ্গে খেলার জন্য আরেকটি মেয়ে গ্রাম থেকে বাসায় আনা হয়েছে। তবে সে তার সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকতে চায় না এখন। শূন্য বাসায় কেবল ঘুরছে। কার্টুনও বেশি সময় দেখছে না। সারাক্ষণ মায়ের কাছে যাওয়ার বায়না তার।

রাতে বাধ্য হয়ে এক ঘরে ঘুমাতে হয়। মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে নিজেকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেন অনিন্দিতা। সারাক্ষণ শঙ্কায় থাকেন আর প্রার্থনা করেন, মেয়েকে যেন না ছুঁই এই ব্যাধি।

এর মধ্যেই একদিন মেয়ের জ্বর এল। পরিবারের সবার মন খারাপ হয়ে গেল। অঞ্জন বললেন, ‘তিন রোগীকে নিয়ে আমার ব্যস্ততা। এর মধ্যে একদিন জ্বর এল মেয়ের।

আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। পরে দেখি পরদিন থেকে আর নেই। অন্য কোনো উপসর্গও নেই। তাতে শান্তি।’

ঘরের লোকদের অসুস্থতার দায় নিজেদের দিলেন এই চিকিৎসক দম্পতি। দুজনই প্রতিদিন হাসপাতালে যেতেন। করোনা রোগীদের সংস্পর্শে থাকতেন। বোয়ালখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনিন্দিতাকে রাত্রিকালীন সেবাও দিতে হতো। সেখান থেকে কোনোভাবে আক্রান্ত হতে পারেন মনে করছেন। অনিন্দিতা বলেন, ‘আমার শ্বশুর-শাশুড়ি বাসার বাইরে যান না। আমাদের মাধ্যমেই তাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন।’

চিকিৎসা শেষে বয়স্ক দুজন বাসায় ফিরেছেন। এখনো তিনজনের কারও করোনা নেগেটিভ হয়নি। তাই অহনা এখনো আদরবঞ্চিত। আর কত দিন তাকে এভাবে অবহেলা পেতে হবে, কে জানে। মাসহ সবার মনও পড়ে আছে ছোট্ট অহনাতে। কখন আবার সুস্থ হবেন তাঁরা!

অহনা নামের অর্থের মতোই নতুন এক আলোকরশ্মির সকাল আসবে পৃথিবীতে, মেয়েটিকে আলিঙ্গন করবে প্রাণভরে। মায়ের আদরে সব ব্যথা দূর হবে, আবার আনন্দে ভরে উঠবে অহনার পৃথিবী।