জঙ্গিবাদ ছেড়ে সংসারী হয়েছেন সেই সাতজন

অপরাধ
প্রতীকী ছবি

২০১৬ সাল। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের আক্তারুজ্জামান তখন বাড়ির পাশের একটি ক্যাডেট মাদ্রাসার ৭ম শ্রেণির ছাত্র। সেই মাদ্রাসার এক পিয়ন কয়েক কিশোর শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রথমে সখ্য গড়ে তোলেন। তারপর তাদের নাম লেখান জঙ্গি সংগঠনের খাতায়। জঙ্গি তালিকায় নাম এলে ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বরে র‌্যাবের হাতে আটক হন আক্তারুজ্জামান (১৯)। ২৩ নভেম্বর রংপুর আর কে রোডের শীতল কমিউনিটি সেন্টারে জঙ্গিবিরোধী সমাবেশ ও জঙ্গি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণ করেন আক্তারুজ্জামান ও তাঁর দুই বন্ধু হাফেজ মো. মাসুদ রানা(২২) ও হাফিজুর রহমান (১৯)। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন, এমন প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে সেদিন তাঁদের প্রত্যেককে সরকারিভাবে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয়।

২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালে মার্চ পর্যন্ত চারটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বগুড়া, রংপুর, কুষ্টিয়া ও সিরাজগঞ্জে সাতজনকে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করায় র‍্যাব। এরপর চার বছর পার হয়েছে। আত্মসমর্পণ করা ওই ব্যক্তিরা এখন কেমন আছেন, সেই খোঁজ করেছেন প্রথম আলোর দিনাজপুর, বগুড়া, কুষ্টিয়া ও রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক এবং প্রতিনিধিরা। জানা গেছে, তাঁদের কেউ এলাকায় দোকান করছেন, কেউ কৃষিকাজে মন দিয়েছেন, উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় কেউ, কেউবা চাকরি করছেন। এলাকার লোকজন বলছেন, তাঁদের সবাই ফিরে গেছেন স্বাভাবিক জীবনে।

আত্মসমর্পণ করা ওই ব্যক্তিদের কেউ এলাকায় দোকান করছেন, কেউ কৃষিকাজে মন দিয়েছেন, উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় কেউ, কেউবা চাকরি করছেন। এলাকার লোকজন বলছেন, তাঁদের সবাই ফিরে গেছেন স্বাভাবিক জীবনে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর নড়েচড়ে বসেছিল সব বাহিনী। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একের পর এক অভিযানে নিহত ও গ্রেপ্তার হন বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজন জঙ্গি। উগ্রবাদ নির্মূলের পন্থা হিসেবে বিভিন্ন এলাকায় উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়া ব্যক্তিদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর উদ্যোগ দেওয়া হয়। এসব আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

আজ বৃহস্পতিবার আবার র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছেন এক প্রকৌশলী, এক চিকিৎসক দম্পতিসহ নয়জন নারী-পুরুষ। তাঁরা নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, নব্য জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের সদস্য ছিলেন। তাঁদের নগদ টাকা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছে র‍্যাব সূত্রগুলো।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, বেশ কিছু উগ্রবাদী নারী-পুরুষ বিভিন্নভাবে র‍্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তবে তাঁরা ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এ জন্য তাঁদের পুনর্বাসনের চিন্তা র‍্যাব করছে।

দিনাজপুরের সেই কিশোরেরা

২০১৬ সালে ঘোড়াঘাট উপজেলার বুলাকিপুর ইউনিয়নের হাফেজ মাসুদ রানা যখন র‌্যাবের হাতে আটক হন, তখন তিনি মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন। আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া শেষে বাড়ি ফিরে ঢাকার উত্তরায় একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল এবং বগুড়া সরকারি শাহ সুলতান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

২০১৬ সালে ঘোড়াঘাট উপজেলার বুলাকিপুর ইউনিয়নের হাফেজ মাসুদ রানা যখন র‌্যাবের হাতে আটক হন, তখন তিনি মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন। আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া শেষে বাড়ি ফিরে ঢাকার উত্তরায় একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল এবং বগুড়া সরকারি শাহ সুলতান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

মাসুদ রানার মা খাদিজা বেগম বলেন, ‘এমনিতে মাসুদ খুব শান্তশিষ্ট ছিল। কখন যে ভুল পথে পা দিয়েছে, আমরা বুঝতে পারিনি। আমার এক বোনের জামাই র‌্যাবে চাকরি করতেন। তাঁর মাধ্যমে আমার ছেলে আত্মসমর্পণ করতে পেরছে।’

পরিবারের সদস্যরা জানান, আত্মসমর্পণের ১৫ দিন আগে মাসুদকে র‌্যাবের হাতে তুলে দেন তাঁর বাবা। আত্মসমর্পণের পরে ৬২ দিন পর্যন্ত মাসুদকে হেফাজতে রেখে পর্যবেক্ষণ করে র‌্যাব। এই সময়ে বাড়ির লোকজন ঢাকায় র‌্যাবের সদর দপ্তরে গিয়ে মাসুদকে দেখে আসতেন। ৬২ দিন পর পরিবারের কাছে তাঁকে তুলে দেওয়া হয়। বর্তমানে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন তিনি। সরকার থেকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ টাকা নগদ দিয়েছে আর চার লাখ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে মাসুদ ও র‌্যাবের নামে যৌথ অ্যাকাউন্টে জমা রাখা আছে। প্রতি তিন মাস পর মাসুদ ও তাঁর বাবা রংপুরে গিয়ে ব্যাংক থেকে লাভের ১০ হাজার ৮৮৮ টাকা তুলে নিয়ে আসেন।

আত্মসমর্পণকারীদের আরেকজন হাফিজুর রহমানের (১৯) বাড়িও দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে। ৭ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। আত্মসমর্পণের পর আবার পড়াশোনা শুরু করেন হাফিজুর। বর্তমানে জয়পুরহাটের একটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। করোনার কারণে কলেজ বন্ধ থাকায় বাবার সঙ্গে পোলট্রি ব্যবসায় লেগেছেন। গত সোমবার দুপুরে হাফিজুরকে পাওয়া গেল স্থানীয় বাজারে বাবার দোকানে। তিনি বলেন, ‘নিজের ভুল বুঝতে পারছি এখন। পুরোনো দিনের স্মৃতি আর মনে করতে চাই না। আত্মসমর্পণের আগে যে ভয় মনে ঢুকেছিল, সেই ভয় আজও আছে। অপরিচিত কাউকে দেখলেই আঁতকে উঠি। প্রতিবেশীরাও অনেক বুঝিয়েছে আমাকে। তাদের কথায় মনোবল বেড়েছে।’ হাফিজুরের বাবা জিল্লুর রহমানও জানালেন, প্রতিবেশীরা খুব সাহায্য করেছেন, খোঁজখবর রেখেছেন।

আত্মসমর্পণকারী আরেকজন আক্তারুজ্জামান। তাঁর বয়সও এখন কুড়ির কোঠায়। এখন উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ছেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমে যখন বাড়িতে ফিরে এলাম, সবাই আমাদের দেখতে আসত। বাড়ি থেকে বের হতাম না। নিজেকে অপরাধী অপরাধী লাগত। এখন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পড়াশোনা করতে পারছি। পড়াশোনার ফাঁকে বাবাকে সহযোগিতা করছি। এখন অনেক ভালো আছি।’

গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে যে পাঁচ জঙ্গি (হামলাকারী) নিহত হন, তাঁদের একজন খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল। আবদুল হাকিম (২৬) নিহত খায়রুলের বন্ধু। হাকিম ও খায়রুল একই সঙ্গে ডিহিগ্রাম ফাজিল মাদ্রাসা থেকে ২০১৫ সালে আলিম পাস করেন, কোচিং করার নাম করে তাঁরা একসঙ্গে বাড়ি ছেড়েছিলেন।

বগুড়ার হাকিম ব্যবসা করেন

গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে যে পাঁচ জঙ্গি (হামলাকারী) নিহত হন, তাঁদের একজন খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল। আবদুল হাকিম (২৬) নিহত খায়রুলের বন্ধু। হাকিম ও খায়রুল একই সঙ্গে ডিহিগ্রাম ফাজিল মাদ্রাসা থেকে ২০১৫ সালে আলিম পাস করেন, কোচিং করার নাম করে তাঁরা একসঙ্গে বাড়ি ছেড়েছিলেন।

আবদুল হাকিমের বাড়ি শাহজাহানপুর উপজেলায়। তিনি এখন স্থানীয় বাজারে মনিহারি দোকান করেন। দুই বছর আগে বিয়ে করেছেন, একটি ছেলেও আছে।
হাকিম প্রথম আলোকে বলেন, খায়রুল প্রথম কোনোভাবে জঙ্গিবাদে যুক্ত হয়েছিলেন, এরপর তাঁকেও জড়ান। র‍্যাবের কাছে আত্মসমর্পণের পর প্রথমে ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেন। পরে বাড়ি ফিরে দোকান দেন। তিনি বলেন, ‘ওই সময় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় আমার পরিবারকে। সামাজিকভাবে পুরো পরিবারটি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। মর্যাদা হারাতে হয়। মাঠে, বাজারে—সব জায়গাতে ভাইবোনেরা প্রশ্নের মুখোমুখি হতেন। যখন বিয়ের কথা উঠল, তখন কেউ মেয়েও দিতে চাচ্ছিল না। তবে এখন আর সেই অবস্থা নেই। এখন এলাকার লোকজনের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই মেলামেশা করছি।’

হাকিম বলেন, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে যে তাঁকে জঙ্গিবাদে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেটা তিনি এখন বুঝতে পারেন। উগ্রবাদী সংগঠনের কেউ আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগও করেন না। তিনি নিজের মতো ব্যবসা ও সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন।

মাহমুদুল এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। চাকরি করছেন। পরিবারকে সময় দিচ্ছেন।
মোশাররফ হোসেন, সাঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান

হাকিমের সঙ্গে একই দিনে আত্মসমর্পণ করেছিলেন গাইবান্ধার সাঘাটার মাহমুদুল হাসান ওরফে বিজয় (২১)। বগুড়ার একটি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে বিজয় এখন একটি সৌরবিদ্যুৎ বিপণনকারী সংস্থায় চাকরি করেন। সাঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন বলেন, মাহমুদুল এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। চাকরি করছেন। পরিবারকে সময় দিচ্ছেন।
আর কুষ্টিয়ার মোর্শেদ শরীফ কল্লোল আত্মসমর্পণের পর আট মাস সৌদি আরবে ছিলেন। দেশে ফিরে কৃষিকাজে যুক্ত হয়েছেন। এখন সবই চলছে ভালোভাবে। তাঁর দুই ছেলে দুই মেয়ে পড়াশোনা করছে। র‍্যাবের কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যে ফোন দেন। সামাজিকভাবেও কোনো সমস্যা নেই।

কুষ্টিয়ায় আত্মসমর্পণকারী জেএমবি সদস্য সালাউদ্দীন আহম্মেদ ওরফে সুজন (৩৪) এখন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বিভিন্ন দোকানে মনিহারি সামগ্রী সরবরাহ করছেন। পাশাপাশি বাড়িতে গাড়ল পালন করছেন। তাঁর বাড়ি চকরাজাপুর ইউনিয়নে। ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজুল আযম জানান, আত্মসমর্পণের পর থেকে সালাউদ্দিন এলাকাতেই থাকেন। প্রায়ই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। তাঁর আচরণও স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। স্থানীয় লোকজনই সেটাই মনে করেন।