জনপ্রিয় হচ্ছে সাশ্রয়ী সৌরবিদ্যুৎ সেচ

ঢাকার ধামরাই উপজেলার রাওয়ারটেক গ্রামে দুই বছর আগে স্থাপন করা হয়েছে সৌরবিদ্যুৎ-চালিত পাম্প। পাম্পটির পানি দিয়ে প্রতিদিন ৭৫ বিঘা জমিতে সেচ দেওয়া যায় l ছবি: সাহাদাত পারভেজ
ঢাকার ধামরাই উপজেলার রাওয়ারটেক গ্রামে দুই বছর আগে স্থাপন করা হয়েছে সৌরবিদ্যুৎ-চালিত পাম্প। পাম্পটির পানি দিয়ে প্রতিদিন ৭৫ বিঘা জমিতে সেচ দেওয়া যায় l ছবি: সাহাদাত পারভেজ

ঢাকার ধামরাই উপজেলার রাওয়ারটেক গ্রামের কৃষক মো. শহিদ মিয়া এ বছর ৪১ শতাংশ জমিতে সেচ নিচ্ছেন সৌরবিদ্যুৎ-চালিত পাম্প থেকে। এর মধ্যে ২৬ শতাংশে (স্থানীয় মাপে এক বিঘা) তিনি বোরো ধান করছেন। ১৫ শতাংশে লাগিয়েছেন ভুট্টা।
একই গ্রামের মানিক মিয়া, মোহরউদ্দিনসহ ২২ জন কৃষকের প্রায় ৬১ বিঘা জমির বোরো ধান ও ভুট্টাখেতে সেচ দেওয়া হচ্ছে সৌরবিদ্যুৎ-চালিত একটি পাম্প থেকে। দুই বছর আগে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির (ইডকল) উদ্যোগে সুয়াপুর ইউনিয়নের ওই গ্রামে পাম্পটি স্থাপন করা হয়। এতে ব্যয় হয় ৩৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে জার্মানির কেএফডব্লিউ উন্নয়ন ব্যাংক অনুদান দিয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। বিশ্বব্যাংকের ঋণ সাড়ে ১০ লাখ।
পাম্পটি চালাতে বিদ্যুৎ লাগে সাড়ে ৭ কিলোওয়াট। প্যানেল বসানো হয়েছে ৮ দশমিক ৪ কিলোওয়াট পিক ক্ষমতার। পাম্পটির পানি তোলার ক্ষমতা দৈনিক ৩ লাখ ৮৪ হাজার লিটার, যা দিয়ে প্রায় ৭৫ বিঘা (১০ হেক্টর) জমিতে সেচ দেওয়া যায়। এর চেয়ে ছোট ও বড় আকারের বিভিন্ন ক্ষমতার পাম্প রয়েছে। ওই পাম্পটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নুসরা। এর আগে রাওয়ারটেকের ওই কৃষকেরা জমিতে সেচ দিতেন ডিজেলচালিত পাম্প থেকে।
৭ মার্চ ওই তিন কৃষক নিজেদের বোরো খেতের পাশে বসে কথা বলেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, সৌরবিদ্যুৎ-চালিত পাম্প থেকে সেচ নিতে ব্যয় কম। বোরো ধানের প্রতি শতাংশ জমিতে সেচের জন্য দিতে হয় ১০০ টাকা। আর ভুট্টার জমিতে প্রতি শতাংশের জন্য ২০ টাকা। কারণ, ভুট্টার জমিতে ফসল লাগানো থেকে তোলা পর্যন্ত বার তিনেকের বেশি সেচ লাগে না।
তাঁরা যখন ডিজেলচালিত পাম্প থেকে সেচ নিতেন তখন বোরো ধানের প্রতি শতাংশ জমিতে সেচের জন্য ১৭০ টাকা দিতেন বলে জানান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডিজেলচালিত পাম্পের সেচের জন্য এখনো শতাংশপ্রতি ১৭০ টাকাই দিতে হয়। আর গ্রিডের বিদ্যুৎ-চালিত পাম্পের ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে দিতে হয় ১৫০ টাকা।
ধামরাইয়ের ওই কৃষকেরা বলেন, সৌরবিদ্যুৎ-চালিত পাম্প থেকে সেচ নেওয়ায় তাঁরা ফসল ওঠার পর সেচের টাকা পরিশোধ করারও সুবিধা পাচ্ছেন। তা ছাড়া, ডিজেলচালিত পাম্পের ক্ষেত্রে সময়মতো জ্বালানি ও পানি পেতেও সমস্যা হতো। এখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রয়োজনীয় পানির সরবরাহ অব্যাহত থাকে।
সৌরবিদ্যুৎ-চালিত পাম্প থেকে সেচ নেওয়ার প্রতি আগ্রহ সারা দেশেই ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। এ কারণেই ২০১১-১২ সালে যেখানে মাত্র পাঁচটি সৌরবিদ্যুৎ-চালিত সেচপাম্প পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছিল, সেখানে এ বছর সারা দেশে এই ধরনের সেচপাম্প চলছে প্রায় ২০০। তা ছাড়া, সৌরবিদ্যুৎ-চালিত পাম্পের সেচ পরিবেশবান্ধবও। এতে কোনো শব্দ কিংবা ধোঁয়া নেই। মাঠেঘাটে তেলও ছড়ায় না।
ইডকলের উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে ১২৪টি। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) পাইলট প্রকল্পের আওতায় ৪০টি। কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ‘সৌরশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্প’-এর আওতায় ১১টি। এ ছাড়া কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা সৌরবিদ্যুৎ-চালিত কয়েকটি পাম্প চালু করেছে।
সরকারও সেচের জন্য সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার উৎসাহিত করছে। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ২০১৭ সালের মধ্যে এই ধরনের দেড় লাখ সেচপাম্প চালু করা। লক্ষ্য বাস্তবায়নে ইডকল, আরইবি ও বিএডিসি আলাদা আলাদা পরিকল্পনা করেছে। ইডকলের নতুন ২০০ পাম্প স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। তা ছাড়া, ইডকল ২০২৫ সালের মধ্যে মোট ৫০ হাজার সৌরবিদ্যুৎ-চালিত সেচপাম্প স্থাপনের কর্মসূচি নিয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন সংস্থার নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিভাগের প্রধান মো. এনামুল করিম।
আরইবির নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম জাফর সাদেক জানিয়েছেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় ৩৭৫টি পাম্প স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া, তাঁদের দুই লাখ পাম্প বসানোর একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মোজাম্মেল হক বলেন, তাঁদের ৪৫০টি পাম্প স্থাপনের একটি প্রকল্প প্রস্তাব কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের কয়েকজন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, সেচের জন্য ডিজেলের পরিবর্তে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে দেশের অর্থনীতিতে এক বিশাল অগ্রগতি হবে। কারণ, প্রতিবছর ডিজেল আমদানির জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা তো ব্যয় হয়ই, উপরন্তু এই খাতে সরকারের ভর্তুকিও দিতে হয়। সড়ক, নৌ ও রেলপথে বিপুল পরিমাণ ডিজেল সময়মতো দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছানোর ব্যয়বহুল কাজটিরও আর দরকার হবে না।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এ এম বদরুদ্দোজা জানিয়েছেন, গত বছর (২০১৪ সাল) সেচের জন্য ডিজেল ব্যবহৃত হয়েছে প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন, যা ওই বছর দেশে মোট ব্যবহৃত ডিজেলের প্রায় ৩১ শতাংশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছর ডিজেলে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কৃষি ও সেচে ব্যবহৃত ডিজেলের জন্য ভর্তুকির পরিমাণ ছিল প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। এ বছর ডিজেলের দাম কম থাকায় ভর্তুকি না লাগলেও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে প্রয়োজনীয় ডিজেল আমদানি করতেই হবে।
শুধু ডিজেল নয়, সেচের জন্য বাড়তি বিদ্যুৎ সরবরাহ করাও প্রতিবছর সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, এ বছরও সেচের জন্য প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুতের নিয়মিত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। একই সময় শুরু হয় বিদ্যুতের গ্রীষ্মকালীন বাড়তি চাহিদা। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে গ্যাস সরবরাহের জন্য সার কারখানা বন্ধ রাখতে হয়। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অব্যাহতভাবে চালু রাখতে হয়। এসবই বিপুল ব্যয়সাপেক্ষ।
এসব সমস্যার একমাত্র সমাধান হতে পারে সৌরবিদ্যুতের সেচ নিশ্চিত করা গেলে। তবে দু-এক বছরের মধ্যে এটি করা সম্ভব নয়। কারণ, দেশে প্রতিবছর সেচপাম্প চলে প্রায় ২০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ১৬ লাখই চলে ডিজেলে। অন্যগুলো বিদ্যুৎ-চালিত।
তা ছাড়া, ইডকল, আরইবি ও বিএডিসি—তিনটিই সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও সেচপাম্প স্থাপনে তাদের অনুসৃত নীতি অভিন্ন নয়। বেসরকারি যেসব সংস্থা এই ধরনের পাম্প স্থাপন করছে তাদের নীতি হচ্ছে মুনাফাভিত্তিক। সব প্রতিষ্ঠানের সেবার মানও সমান নয়। ফলে বিভিন্ন এলাকায় গ্রাহকের মধ্যে কিছু কিছু বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ ক্ষেত্রে আরও একটি প্রশ্ন রয়েছে। সেচ মৌসুমের পর কি পাম্পগুলো পরবর্তী মৌসুমের অপেক্ষায় বসিয়ে রাখা হবে? তা হলে তো খরচ অনেক বেশি পড়বে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইডকলের উপপ্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম ফরমানুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমত যেসব এলাকায় তিনটি ফসল হয় আপাতত সেখানে পাম্পগুলো করা হচ্ছে। তাতে মোটামুটি সারা বছরই পাম্পগুলোর কম-বেশি ব্যবহার থাকবে। কারণ, এখন অনেক এলাকায় আমন মৌসুমেও সেচ দরকার হয়। অনেক রবিশস্যেও সেচ লাগে। তা ছাড়া, বোরো মৌসুমের পর সেচপাম্পের প্যানেলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ধান মাড়াই, গম ভাঙানো, হলুদ-মরিচসহ মসলার গুঁড়া করা প্রভৃতি কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। অনেক এলাকায় এসব কাজ শুরুও করা হয়েছে।