জনবলসংকটে রেলের ১০৬টি স্টেশন বন্ধ

জনবলসংকটের কারণে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের ১৭০টি স্টেশনের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ৫৬টি। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথেই বন্ধ রয়েছে ১৪টি স্টেশন। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতেও একই অবস্থা। সেখানে ১৭৩টি স্টেশনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে ৫০টি। পূর্ব ও পশ্চিম মিলে দেশের ৩৪৩টি রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে ১০৬টিই এখন বন্ধ রয়েছে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, বন্ধ থাকা স্টেশন পার হওয়ার সময় মাত্র ১৬ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলে। এতে ট্রেনের পরিচালন সময় বেড়েছে। পূর্বাঞ্চলের ঢাকা বিভাগে ৩৬টি এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ২০টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে বন্ধ রয়েছে ভাটিয়ারী, বাড়বকুণ্ড, বারৈয়াঢালা, মিরসরাই, মাস্তাননগর, মুহুরীগঞ্জ, কালীদহ, শর্শদী, নাওটি, আলীশহর, ময়নামতি, রাজাপুর, আমিরগঞ্জ ও ঘোড়াশাল স্টেশন। তবে বন্ধ থাকা স্টেশনগুলোতে লোকাল ট্রেন থামে। কিন্তু জনবলের অভাবে নিয়মিত টিকিট বিক্রি করা সম্ভব হয় না। এতে রেলের রাজস্ব আদায়ে প্রভাব পড়ছে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ১৪টি বন্ধ স্টেশন পার হতে আগের চেয়ে প্রতিটি ট্রেনের গড়ে প্রায় এক ঘণ্টা বেশি সময় লাগছে।
এ বিষয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার পরও ট্রেনের গতি বাড়াতে না পারার অন্যতম কারণ মাস্টারের অভাবে অনেক স্টেশন বন্ধ থাকা। বন্ধ স্টেশন অতিক্রম করার সময় ট্রেনের গতি কমিয়ে আনা হয়। বন্ধ থাকা প্রতিটি স্টেশন পার হতে ট্রেনের প্রায় পাঁচ মিনিট করে সময় অপচয় হচ্ছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত বছর পূর্বাঞ্চলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ১২টি স্টেশন। এর আগে ২০০১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বন্ধ করা হয়েছে ৪৪টি স্টেশন। একইভাবে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে ২০০৭ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয় ১৬টি স্টেশন। ২০১২ সালে এসে বন্ধ হওয়া স্টেশনের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০-এ। পরে অবসরে যাওয়া কিছু স্টেশনমাস্টারকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ২০টি স্টেশন আবার চালু করা হয়।
পশ্চিমাঞ্চলে রেলেওয়ের লালমনিরহাট বিভাগে ৫৯টির মধ্যে ১৬টি ও পাকশী বিভাগে ১১৪টির মধ্যে ৩৪টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মো. খায়রুল আলম বলেন, স্টেশন বন্ধ থাকার কারণে রেলের পরিচালন সময় যেমন বেড়েছে, তেমনি সরকারের রাজস্ব আদায়ও কমেছে। এ ছাড়া বন্ধ থাকা স্টেশনের যন্ত্রপাতি ও সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
স্টেশন মাস্টারের অভাবে ২০১২ সালের মে মাসে ভাটিয়ারি স্টেশনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরেজমিনে গত মঙ্গলবার এই স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, একজন পয়েন্টসম্যান সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁকে সহযোগিতা করেন একজন স্টেশন কুলি। পয়েন্টসম্যানের কাজ হচ্ছে এক লাইন থেকে অন্য লাইনে ট্রেন যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া।
পয়েন্টসম্যান জাফর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ভাটিয়ারি স্টেশনে তিনজন স্টেশন মাস্টার পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁরা স্টেশনের কারিগরি বিষয় নিয়ন্ত্রণ এবং টিকিট বিক্রি করতেন। তাঁরা না থাকার কারণে স্টেশনের প্যানেল বোর্ড সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। স্টেশনের চারটি লাইনের মধ্যে ১ ও ৪ নম্বর লাইনটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে ৩ ও ৪ নম্বর লাইন দিয়ে কেবল ট্রেন চলাচল করে।
ভাটিয়ারি এলাকার বাসিন্দা মো. শওকত হোসেন বলেন, স্টেশনটি বন্ধ হওয়ার পর চারটি লাইনের মধ্যে এখন মাঝের দুটি লাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল করে। লোকাল ট্রেনগুলো ৩ ও ৪ নম্বর লাইনে থামে। এতে নারী ও শিশুদের ওঠানামায় সমস্যা হয়।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (সিসিএম) সরদার সাহাদাত আলী প্রথম আলোকে বলেন, বন্ধ থাকা স্টেশনে জনবলের অভাবে নিয়মিত টিকিট বিক্রি করা যায় না। এতে রেলের রাজস্ব আদায়ে প্রভাব ফেলছে।
রেলের একাধিক প্রকৌশলী জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের পুরো অংশ ইন্টারলক পদ্ধতির। অর্থাৎ প্রতিটি স্টেশনে বিদ্যমান দুটি লাইনের (আপ ও ডাউন রেলপথ) সঙ্গে আরও একাধিক লাইন থাকে। তখন স্টেশনমাস্টার আপ বা ডাউন লাইন দিয়ে আসা একটি ট্রেনকে ১, ২ বা ৩ নম্বর লাইন দিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন। আর স্টেশন বন্ধ থাকলে এই তিনটির মধ্যে কেবল একটি লাইন দিয়েই ট্রেন যেতে পারবে। তখন লোকো মাস্টার (ট্রেনচালক) দূর থেকে ফেসিং পয়েন্ট (আপ বা ডাউন লাইনের সঙ্গে একাধিক লাইনের সংযোগ) পর্যবেক্ষণ করে গতি কমিয়ে স্টেশন পার হন, যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। অর্থাৎ যে স্টেশনগুলো বন্ধ, সেখানে এক লাইন থেকে আরেক লাইনে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ জন্য ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি ১৬ কিলোমিটার বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
রেলওয়ের পরিচালন বিভাগ সূত্র জানায়, একটি স্টেশনে কমপক্ষে তিনজন মাস্টার থাকার নিয়ম রয়েছে। তাঁদের সহযোগিতা করেন আরও তিনজন পয়েন্টসম্যান। সব মিলিয়ে সাতজন নিয়ে একটি স্টেশন সচল রাখা হয়। তাঁরা পালাক্রমে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেন। বন্ধ থাকা প্রতিটি স্টেশনের প্যানেল বোর্ড বা সিগ্যাল কেবিন অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এটি দিয়ে রেল চলাচলের দিকনির্দেশনা দেওয়া হতো। এসব যন্ত্রের দাম কয়েক লাখ টাকা।
একের পর এক স্টেশন বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প) মো. মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, সহকারী স্টেশনমাস্টার নিয়োগ বন্ধ থাকার কারণে অনেক স্টেশন বন্ধ করে দিতে হয়েছে। যেসব স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে, সেখানে কোনো মাস্টার ছিল না।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে সহকারী স্টেশনমাস্টার নিয়োগের প্রক্রিয়া শেষ হয়। তখন ৮১ জনের প্যানেল তৈরি করে তাঁদের নিয়োগ চূড়ান্ত করেছিল কর্তৃপক্ষ। ওই সময় গণমাধ্যমে নিয়োগ-প্রক্রিয়া নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে ওই নিয়োগ-প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। পরে একাধিকবার বিজ্ঞপ্তি দিয়েও সহকারী স্টেশনমাস্টার নিয়োগ দিতে পারেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ৮১ জনের মধ্যে কয়েকজন তাঁদের নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে আদালতে মামলা করেন।
এ বিষয়ে মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ২০০৬ সালে নিয়োগের জন্য মনোনীত ৮১ জনের মধ্যে কয়েকজন আদালতের রায় পান। আদালতের রায় মেনে তাঁদের মধ্যে ১০-১১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদের নিয়োগের বিষয়টি কেন ঝুলে আছে, তা জানতে চাইলে রেলের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন বলেন, ‘২০০৬ সালে ৮১ জনকে নিয়োগের জন্য একটি প্যানেল তৈরি করা হয়েছিল। ওই প্যানেলে কারা চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েছিলেন তা আমি জানি না।’
২০০৬ সালে সহকারী স্টেশনমাস্টার নিয়োগ কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন মিহির কান্তি গুহ। তিনি এখন রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ২০০৬ সালে নিয়োগ চূড়ান্ত করা ৮১ জনের মধ্যে ৬৭ জনের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, ৮১ জন নিয়ে জটিলতার পর নতুন করে স্টেশনমাস্টার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কয়েকজন আদালতে যান। পরে ওই নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ওই জটিলতা শেষে নতুন করে আবার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় এবং ৩০ জন নতুনভাবে নিয়োগ পেয়ে এখন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। শূন্য আরও ২৭০ পদে নিয়োগের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন আছে।