জারিফের প্রশ্নের উত্তর কঠিন নয় কষ্টের

চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র জারিফ বিন নেওয়াজের (১১) মনে অনেক প্রশ্ন। তাকে কেউ কিছু বলছে না। কিন্তু চারপাশে অনেক কথা। বাবা যদি অক্টোবরের মধ্যে ভালো হয়ে যান তাহলে তো স্কুলের অনুষ্ঠানে যেতে পারবেন। হাসপাতালের রেজিস্ট্রার খাতায় নিশ্চয়ই তার মা সুমাইয়া খানম কোথায় ভর্তি আছে তা জানা যাবে। তাই নার্সদের রেজিস্ট্রার খাতা এনে দেখানোরও বায়না ধরে। বড় ভাই শালীন বা সবচেয়ে আদরের ছোট ভাই জায়ানই বা কোথায়?
জারিফের কাছ থেকে এসব প্রশ্ন ও ভাবনার কথা শুনে জারিফের স্বজনেরা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। এ ছাড়া আর কি ই বা করবেন। জারিফ এখনো জানে না তার বাবা, মা আর দুই ভাই বেঁচে নেই। পরিবারের মধ্যে শুধু সে একাই বেঁচে আছে।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ৮ নম্বর বাড়ির সাততলার একটি ফ্ল্যাটে মার্কিন দূতাবাসের প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ সপরিবারে দগ্ধ হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আনার পরপরই মারা যায় তাঁর ছেলে শালীন বিন নেওয়াজ (১৫) ও ১৪ মাসের শিশু জায়ান বিন নেওয়াজ। এক দিন পর মারা যান শাহনেওয়াজ (৫০)। শরীরের ৯০ ভাগ পোড়া নিয়ে সিটি হাসপাতালে শাহনেওয়াজের স্ত্রী সুমাইয়া খানমও মারা গেছেন। দগ্ধ জারিফকে নিয়ে তাই স্বজনদের শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হচ্ছে।
বুধবার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত সিটি হাসপাতালে জারিফের ডান হাত ও পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে। ডান পায়ের ঊরু থেকে চামড়া নিয়ে ডান হাত এবং ডান পায়ে লাগানো হয়েছে। অস্ত্রোপচারের পর সে হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) ভর্তি ছিল। এখন আছে হাসপাতালের ৫১০ নম্বর কেবিনে।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে কেবিনে গিয়ে দেখা যায় অস্ত্রোপচারের ধকলে জারিফ অনেকটাই ক্লান্ত। অস্ত্রোপচারের পর এইচডিইউতে সারারাত খুব ছটফট করেছে। কান্নাকাটি করেছে। কেবিনে আনার পর থেকে একটু শান্ত হয়েছে, তবে কথা খুব কম বলছে।
জারিফের খালা তাসনিমা খান বলেন, ‘এসডিইউতে গিয়ে শুধু ওর মায়ের কথা জানতে চায়। ও জানত, ওর মাকে এখানেই রাখা হয়েছিল। বলে, আমার মাকে কোন বিছানায় এনে রাখছিল একটু দেখাও না। বলে, আমার আম্মু সুমাইয়া খানম কোন জায়গায় আছে লিস্টটা নিয়ে এসো। একটু পরপর বলে, ওর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ওর জন্য সবাই দোয়া করেন।’
তাসনিমা খান বলেন, ‘ও আমাকে আম্মু ডেকে ফেলে। পরে আবার নিজেই বলে, আম্মু না, খালামনি। পরে নিজেই বলে, আম্মুদের যে কি অবস্থা তা জানি না।’ জারিফ নিজেই খালাদের কাছে বলেছে, ওই দিনের আগুনের ঘটনায় নাকি তার ‘মেমোরি’ বা স্মৃতি অনেক নষ্ট হয়ে গেছে। আগুনে বড় ভাইয়ের পুরো মাথা লাল হয়ে গিয়েছিল সে স্মৃতিও তার স্পষ্ট। নিজের মনের প্রশ্নগুলোর উত্তর না পেয়ে রাতে ঘুমানোর আগে বালিশ গুছিয়ে কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে যায়।
জারিফ মাকে ছাড়া একদিনের জন্যও কোথাও ঘুমাত না। মা খাবার মুখে তুলে না দিলে খেত না। সেই জারিফ ২৬ ফেব্রুয়ারির পর থেকে মা ছাড়া। ছোট ভাইকে অসম্ভব ভালোবাসত। তাই ঘুরেফিরে তার কথাও জানতে চায়।
দুর্ঘটনার পর থেকে জারিফ মুগদায় তার মামার বাসায় থাকছে। হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে একটু পরপর জানতে চায় মামি কখন আসবে। জারিফের খালারা জানালেন, মামি তাকে অনেক ভালোবাসেন। জারিফের কাছে কেউ গেলে নিজেই সচেতন হয়ে বলছে-আমার পা, আমার পা। নার্স ইনজেকশন দেওয়ার পর নিজেই ফুঁ দিয়ে যন্ত্রণা কমানোর চেষ্টা করে। হাতে ছোট দুটি খেলনা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল অনেকক্ষণ ধরে। মোবাইল সেট দিয়ে গেম খেলে কিছুক্ষণ। খালাদের এনে দেওয়া চকলেট পাশেই রাখা। সেদিনে খুব একটা মনোযোগ আছে বলে মনে হলো না। এক সময় নিজেই ভাত খেতে চায়। খালা উম্মে হাবিবা বিরিয়ানি রান্না করে এনেছেন। একটু খেয়ে আর খেল না।
আজ উত্তরা থেকে জারিফকে দেখতে এসেছেন স্পর্শ ডে কেয়ার সেন্টারের পরিচালক সিদ্দিকাতুল হক। তাঁর মেয়ের সঙ্গে জারিফের ভাই পড়ত। বরিশাল থেকে খালু জুলফিকার আলী খান এসেছেন ওর সঙ্গে হাসপাতালে থাকার জন্য।
সিটি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের কনসালট্যান্ট শহীদুল বারী প্রথম আলোকে বলেন, জারিফের ১১ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। ৬ শতাংশ জায়গায় অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। ক্ষতটা ভালো হলে ওকে মানসিক চিকিৎসা দিতে হবে।
শাহনেওয়াজের বাড়ি ঝালকাঠির কাঠপট্টিতে। তাঁরা ছিলেন চার ভাই। শাহনেওয়াজের ভাই কামরুল আহসান জানালেন, ঘটনার পর পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। মামলার তদন্ত চলছে। দুই পরিবার চেষ্টা চালাচ্ছে জারিফকে ভালো করে তোলার। ও সুস্থ হলেই ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করা হবে।