জিন্নাহর ঢাকা সফর কার্জন হলে ভাষণ ছাত্রদের প্রতিবাদ

১৯৪৮ সালের মার্চে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলন যখন চলছে, পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তখন খাজা নাজিমুদ্দীন। গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসবেন ১৯ মার্চ। মুখ্যমন্ত্রীর ভয় ছিল, ওই সময় গভর্নর জেনারেল ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে পড়লে তাঁর রাজনৈতিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই সংগ্রাম পরিষদের কাছে ৮-দফা শান্তি প্রস্তাব দেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রীর শান্তি প্রস্তাব সাগ্রহে মেনে নেয় দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এ বিষয়ে তমদ্দুন মজলিস-প্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের ছিল প্রকাশ্য উৎসাহ। তবে সংগ্রাম পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ তোয়াহা এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, এ পর্যায়ে আন্দোলন স্থগিত করা হলে তা আর সহজে শুরু করা যাবে না। তাঁকে সমর্থন জানান আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ। সাধারণ ছাত্ররাও আন্দোলন স্থগিতের বিরুদ্ধে। তবু সংগ্রাম পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতেরই জয় হয়। ১৫ মার্চ থেকে আন্দোলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ঢাকায় এসে জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কী মতামত প্রকাশ করবেন, সে সম্পর্কে কারও স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও প্রগতিশীল ছাত্র ও রাজনৈতিক মহলে কিছুটা আশঙ্কা ছিল। বাস্তবে সে আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হয়।
একনায়কী স্বভাবের জিন্নাহ ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের নাগরিক সংবর্ধনা সভায় এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তনের ছাত্রসভায় বেশ জোরালো ভাষায় বলেন, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। যারা এর বিরোধিতা করে, তারা পাকিস্তানের দুশমন। তাদের কঠোর হাতে দমন করা হবে।
কার্জন হলে উপস্থিত কিছুসংখ্যক ছাত্র তখনই ‘নো-নো’ বলে প্রতিবাদ করে ওঠেন। কিন্তু তাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। একটু থেমে তিনি তাঁর রাজনৈতিক বক্তৃতা ঠিকই চালিয়ে যান উর্দুভাষিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে এবং সব রকম প্রগতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক চেতনার বিপক্ষে। গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র আস্থা ছিল না।
ভাষা আন্দোলনের পথে এ ঘটনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, পাকিস্তানবাসী বাঙালি-অবাঙালি জনতার ওপর পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ব্যক্তিগত প্রবল প্রভাব ছিল। বলতে হয়, তাঁর প্রতি ছিল অন্ধ মুগ্ধতা। রাষ্ট্রভাষা উর্দু বা বাংলার রাজনৈতিক তাৎপর্য সম্পর্কে জনতার ধারণা খুব স্পষ্ট ছিল না। সে মুহূর্তে তাদের কেউ বুঝিয়ে দেয়নি, উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হলে বাংলাভাষী মানুষ পাকিস্তান রাষ্ট্রের উন্নয়নের পটভূমিতে কতটা পিছিয়ে পড়বে। শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে প্রশ্নটা ঢেউ তুললেও সেখানে ছিল জিন্নাহ বনাম বাংলা রাষ্ট্রভাষা নিয়ে দোদুল্যমানতা। কিন্তু যে ছাত্র যুব সমাজ পাকিস্তান আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে, তাদের বড়সড় অংশে ‘পাকিস্তানি বাদশাহ’র অসংগত বক্তব্য মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।
জিন্নাহর এ বক্তৃতা ছাত্রসমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিক্ষুব্ধ কিছু ছাত্র রেসকোর্স ময়দান থেকে বেরিয়ে এসে ক্ষান্ত হননি, জিন্নাহ-বন্দনায় তৈরি বেশ কয়েকটি তোরণ ভাঙচুর করেন। তাঁরা জিন্নাহর ছবি নষ্ট করেন। এ ঘটনা তখনকার জন্য অভাবিত। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে একাত্তরের মার্চে।
তবু জিন্নাহর ঢাকা সফর ভাষা আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় বিরূপ প্রভাবও সৃষ্টি করে। তমদ্দুন মজলিসসহ মধ্যপন্থীরা এ বিষয়ে সাময়িক নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তাই স্থগিত আন্দোলনের শক্তিমান প্রকাশ ঘটাতে ছাত্রদের প্রায় চার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল, যদিও তাদের চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না। অবস্থা তৎকালীন রাজনৈতিক মহলে এমন ছিল যে জিন্নাহর অগণতান্ত্রিক বক্তৃতার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেননি। একমাত্র ফজলুল হক সাহেব প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানান, যা সংবাদপত্রে প্রকাশ পায়। শেষ পর্যন্ত মোহাম্মদ তোয়াহার ভবিষ্যদ্বাণীই সত্যে পরিণত হয়।
আহমদ রফিক: ভাষাসংগ্রামী, কবি ও রবীন্দ্র-গবেষক