জীবননাশের হুমকি পাওয়ার পর চাকরি হারালেন দুদক কর্মকর্তা

মো. শরীফ উদ্দিন
ছবি: সংগৃহীত

জীবননাশের হুমকি পাওয়ার ১৬ দিনের মাথায় চাকরি হারালেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন।

গত ৩০ জানুয়ারি হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়ে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে চট্টগ্রামের খুলশী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন শরীফ উদ্দিন। আর ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁকে চাকরিচ্যুতির আদেশ দেয় দুদক।

আদেশের দিন থেকেই শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতি কার্যকর হবে বলে দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ স্বাক্ষরিত আদেশে উল্লেখ করা হয়।

আদেশে বলা হয়, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪ (২)-তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মো. শরীফ উদ্দিন (উপসহকারী পরিচালক) দুদক, সমন্বিত জেলা কার্যক্রম, পটুয়াখালীকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হলো। তিনি বিধি মোতাবেক ৯০ দিনের বেতন এবং প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধা পাবেন।’

বদলির পর হঠাৎ করে শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা নিয়ে দুদকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুতির প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন তাঁর সহকর্মীরা। তাঁরা বলছেন, শরীফ উদ্দিন সৎ ও সাহসী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

দুদক সূত্রে জানা যায়, শরীফ উদ্দিন চট্টগ্রামে কর্মরত অবস্থায় কক্সবাজারে ৭২টি প্রকল্পে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি, রোহিঙ্গা নাগরিকদের ২০টি এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতি, কর্ণফুলী গ্যাসে অনিয়মসহ বেশ কিছু দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি মামলা করেন। এতে তিনি অনেকের ‘চক্ষুশূল’ হয়ে উঠেছিলেন।

গত বছরের ১৬ জুন শরীফ উদ্দিনকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়। আর এখন তাঁকে ‘অজ্ঞাত’ কারণে চাকরিচ্যুত করা হলো।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে দুদকের একাধিক কমিশনার ও দুদক সচিবের মুঠোফোনে চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাঁরা ফোন ধরেননি।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনকালে হালনাগাদ ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের পরিচালকসহ ইসির চার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করেন শরীফ উদ্দিন।

রোহিঙ্গা নাগরিকদের অবৈধ উপায়ে জন্মনিবন্ধন সনদ প্রদান ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণের ঘটনায় ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সরফরাজ কাদের রাসেলসহ ৬ জন, ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসমাইল বালিসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

একইভাবে অবৈধভাবে গ্যাসসংযোগ প্রদান করায় সাবেক প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলামের (বিএসসি) বড় ছেলে আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপকমিটির সদস্য মো. মুজিবুর রহমান, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপক মো. মজিবুর রহমান, সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলমের বিরুদ্ধে মামলা করেন শরীফ উদ্দিন। এই মামলায় সারওয়ার, মজিবুর ও দিদারুলকে গ্রেপ্তার করে দুদক।

শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুতির প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন তাঁর সহকর্মীরা
ছবি: সংগৃহীত

এ ছাড়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়েসংলগ্ন কলাতলী বাইপাস রোড এলাকায় পিবিআই অফিস তৈরির জন্য এক একর জমি অধিগ্রহণে জালিয়াতি, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে খালাসি পদে ৮৬৩ জনকে নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ১ কোটি ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপকসহ চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন শরীফ উদ্দিন। এর মধ্যেই শরীফ উদ্দিনকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়।

চট্টগ্রামের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও দুদকে শরীফ উদ্দিনের সহকর্মীদের ভাষ্য, তাঁকে পটুয়াখালীতে বদলি করানোর পেছনে দুর্নীতিবাজ চক্রের হাত রয়েছে। একইভাবে তাঁর চাকরিচ্যুতির পেছনেও এই চক্রের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন আমরা বিভিন্ন চলচ্চিত্রে দেখেছি, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর কারণে সৎ পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা সরকারি কর্মকর্তাকে প্রভাব খাটিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়। এখন তা বাস্তবে দুদকে দেখলাম। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এলাকায় বড় প্রকল্প ও সরকারি অফিসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শরীফ উদ্দিনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সাহসী। তিনি কারও সঙ্গে আপস করেননি। তাঁকে কেন চাকরিচ্যুত করা হলো, তা দুদকের পরিষ্কার করা উচিত।’

এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য দুদক, সরকার ও সর্বোচ্চ আদালতের কাছে আবেদন জানান আখতার কবির চৌধুরী।

যে ক্ষমতাবলে শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুতির আদেশ দেওয়া হয়েছে, সেই দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪ (২)-তে বলা হয়েছে, ‘এই বিধিমালায় ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ না দর্শাইয়া কোনো কর্মচারীকে ৯০ দিনের নোটিশ প্রদান করিয়া অথবা ৯০ দিনের বেতন পরিশোধ করিয়া তাহাকে চাকরি হইতে অপসারণ করিতে পারিবে।’

অবশ্য এই আদেশকে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ, সংবিধানের ১৩৫ (২) নম্বর অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, ‘অনুরূপ পদে (প্রজাতন্ত্রের অসামরিক পদে) নিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে তাহার সম্পর্কে প্রস্তাবিত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাইবার যুক্তিসংগত সুযোগ দান না করা পর্যন্ত তাহাকে বরখাস্ত, অপসারিত বা পদাবনমিত করা যাইবে না।’

শরীফ উদ্দিন পটুয়াখালীতে বদলি হলেও তাঁর পরিবার চট্টগ্রামের খুলশী এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় রয়েছে। তিনি ছুটিতে পটুয়াখালী থেকে চট্টগ্রামে যেতেন।

শরীফ উদ্দিন জানান, পটুয়াখালীতে বদলির পরও তাঁকে নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছিল। হুমকি পেয়ে গত ৩০ জানুয়ারি তিনি জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে চট্টগ্রামের খুলশী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

জিডিতে শরীফ উদ্দিন অভিযোগ করেন, ৩০ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে দুই ব্যক্তি তাঁর বাসায় এসে তাঁকে হুমকি দেন। বলেন, তিনি দুদকে কীভাবে চাকরি করেন, তা তাঁরা দেখে নেবেন। এ ছাড়া তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হয়।

চাকরিচ্যুতির বিষয়ে শরীফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কিছুই বলার নেই। শুধু এটুকু বলব, আমি মজলুম।’