জীবন এত কষ্টের কেন!

বাল্য বিবাহের কারণে সারা জীবন আমাকে কাঁদতে হবে? এত কষ্টের জীবন আমি চাই না। তবে এত সহজে জীবনের হাল ছেড়ে দিই নাই। পড়ালেখা করে নিজ যোগ্যতায় সমাজে আমি প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। আমি চাই, আমার মতো আর কারও জীবন যেন এভাবে নষ্ট না হয়। ছোট বয়সে যেন কারও বিয়ে না হয়। দু: দুঃখের মাঝেও কষ্ট করে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি।’
কথা গুলো একজন বিবাহিত মেয়ে শিশুর। তার দৈনন্দিন জীবনের নানান কথা লিখে রেখেছে ডায়েরির পাতায়-পাতায়।
তার নাম তিসা। ক্লাস নাইনেই বিয়ের হয়ে যায় মিঠুল মিয়ার সঙ্গে। এর কারণ বাবার পরিবারে অভাব অনটনে মধ্য দিয়ে দিন যাপন।
তিসার স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু সে স্বপ্ন-স্বপ্নই থেকে যায়। নাইনে পড়ার সময় বিয়ে হয়। নতুন এই জীবনে প্রবেশ করে প্রথমে পরিবেশগত কারণেই সে ধাক্কা খায়; সংসার, স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়। মনে পড়ে যায় তার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা-সারা দিন দুরন্তপনা আর খেলার সাথিদের সঙ্গে কেটেছে যে জীবন-সেই জীবন এখানে কই! এখানে নিয়মকানুনের বেড়াজাল আর আছে নানা নিষেধাজ্ঞা! আর নিজের জন্য শুধুই কান্না!
ডায়েরি পড়ে আরও জানা যায়, শ্বশুর বাড়ি প্রথমে যাওয়াতে আমার একটুও ভালো লাগে নাই। মনে হতো আমি বাবার বাড়ি ছেড়ে কোথায় এসেছি! মন মানতে চায় না। তারপর নানা কথা শুনতে হয়, সেই কথা গুলো আমি সহ্য করতে পারি না। অন্য দিকে স্বামী কাজ কর্ম কিছুই করে না। তার সঙ্গে সব সময় আমার ঝগড়া হয়, সে খারাপ আচরণ করে। একটু ভালো ব্যবহার, ভালো খাবার-দাবার, পরিচ্ছন্ন পোশাক আর সহযোগিতা তার কাছে আছে আশা করেছিলাম। কিন্তু সে এগুলোর কিছুই করতে পারে না। আমার সারাক্ষণ মনে হতে থাকে আমার এই ছোট জীবনে কোনো সুখ নেই; শুধুই দুঃখ আর দুঃখ। অনেক সময় আমি একা একা বসে আড়ালে কাঁদি।
তিসা ডায়েরির পাতায় আরও লিখেছে, সংসার বিষয়ে আমি এখনো পুরোপুরি বুঝি না। সংসারে স্বামীর কথা শুনতে হয়, শাশুড়ির কথা শুনতে হয় আরও সবার কথা শুনতে হয়, প্রাধান্য দিতে হয় এবং বাধ্য হয়ে তা পালন করতে হয়। এত দুঃখ-কষ্টের মধ্য পরেও আমার স্কুলে যাওয়া আমি বন্ধ করিনি, সংসারের বিভিন্ন কাজ করতে হয় আমাকে, সেই সব কাজ করেই আমি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। ক্লাসের পড়াশোনা থেকে নানা কিছু জানতে পারি-যেমন শরীরকে ভালো রাখতে হলে ভালো আমিষ, পুষ্টিকর জাতীয় খাবারের দরকার, শিশুর বেড়ে উঠার জন্য ভালো খাবারের গুরুত্ব। বাল্যবিবাহের ফলে মা ও তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, বাড়ে মৃত্যু ঝুঁকি। বই পড়ে, ক্লাসে গিয়ে এসব জানতে পারলেও বাস্তব জীবনে এসব পাওয়ার অধিকার নেই। কিন্তু আমি হাল ছাড়তে রাজি নই। বাল্য বিবাহ জীবনের কি যে কষ্ট তা আমি আমার জীবন দিয়ে বুঝতে শিখেছি, পড়াশোনা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, আর তার জন্য চাই সমাজের সহযোগিতার হাত।
সামাজিক ও পারিবারিক পর্যায়ে ঐতিহ্যগতভাবেই মেয়েরা অধিকার বঞ্চিত। সে ক্ষেত্রে বিবাহিত মেয়ে শিশুরা আরও বেশি। একটি দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে মেয়েদের অধিকারগুলো নিশ্চিত করা উন্নয়ন খাতের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত। সুস্থ্য শিশু ও পরিবার নিশ্চিত নিশ্চিতকরনের লক্ষ্যে মায়ের স্বাস্থ্য ও অধিকার সর্বত্র অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। বিশেষ করে বাল্যবিবাহের মধ্য দিয়ে লঙ্ঘিত হচ্ছে তাদের মানবাধিকার। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও খুব একটা কাজ হচ্ছে না। এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৭৩% মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। বিশ্বে মেয়ে শিশু বিবাহের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন চতুর্থ। যেহেতু বাংলাদেশের লক্ষণীয় বিবাহিত নারী জনগোষ্ঠী মেয়ে শিশু, সেই দিক থেকে এই জনগোষ্ঠীকে সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। সে লক্ষকে সামনে রেখে একটি বেসরকারি সংস্থা ‘ইমেজ’ বিবাহিত মেয়ে শিশুটির নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বিবাহিত মেয়ে শিশুদের জন্য একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করতে গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার ৪ হাজার ৫০০ বিবাহিত মেয়ে শিশুদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছে।