
দেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম বড় কারণ পানিতে ডুবে মরা। খাল-বিল-নদী-নালার এই দেশে শিশুদের সাঁতার শেখানো ছাড়া এসব মৃত্যু কমিয়ে আনার কোনো উপায় নেই। এই সরল সত্যটা যাঁরা বুঝেছেন, তাঁরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেননি।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ২০০৫ সাল থেকে বিভিন্ন গ্রামের পুকুরে শিশুদের সাঁতার শেখানো শুরু করে। সাদামাটা উদ্যোগ। পুকুরের একটা অংশে বাঁশের ঘের দিয়ে প্রশিক্ষিত প্রশিক্ষকের মাধ্যমে শিশুদের সাঁতার শেখানো। বিনা পয়সায়। দেশের ২২টি জেলায় শুরু হয় এ কার্যক্রম।
সংগঠনের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৪ সাল থেকে তাঁরা শিশুদের সাঁতার শেখানোর চিন্তাভাবনা শুরু করেন। তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় রয়াল লাইফ সেভিং সোসাইটি-অস্ট্রেলিয়া (আরএলএসএসএ) ও বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশন। কাজে নেমেই দেখা যায়, অনেক সমস্যা। পাঠ্যক্রম নেই। নেই সুইমিংপুল। আর শেখাবে কে? সাঁতার শেখাতেও তো চাই প্রশিক্ষিত প্রশিক্ষক। সুইমিং ফেডারেশনের যাঁরা প্রশিক্ষক, তাঁরা সাঁতারুদের দ্রুত সাঁতার কাটতে শেখানোয় দক্ষ। কিন্তু শিশুদের সাঁতার শেখানোর কৌশল শেখানো একেবারে ভিন্ন ব্যাপার।
অস্ট্রেলিয়া থেকে ছয়জন প্রশিক্ষক পাঠিয়ে দেয় আরএলএসএসএ। তাঁরা এসে সুইমিং ফেডারেশনের প্রশিক্ষকদের আগে শিখিয়ে দেন শিশুদের কীভাবে সাঁতার শেখাতে হবে। প্রশিক্ষিত হয়ে সুইমিং ফেডারেশনের প্রশিক্ষকেরা হন মাস্টার ট্রেইনার। মাস্টার ট্রেইনাররা গ্রামে গিয়ে উৎসাহী নারী-পুরুষদের সমন্বয়ে তৈরি করেন ৫০০ কমিউনিটি ট্রেইনার। এভাবে প্রশিক্ষণ বাড়তে থাকে।
কাজে নামার আগে সিআইপিআরবি দেশের কোন এলাকায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার বেশি, সে তথ্য সংগ্রহ করে। এ ক্ষেত্রে তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ কাজে লাগায়। তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৭ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। মোট শিশুমৃত্যুর ২৮ শতাংশ পানিতে ডুবে মরে। ৮০ শতাংশ শিশু ঘরের পাশে ডোবায় পড়ে মারা যায়।
সিআইপিআরবির গবেষণা থেকে জানা যায়, ৬০ শতাংশ পানিতে ডুবে মরার ঘটনা ঘটে সকাল নয়টা থেকে একটার মধ্যে। কারণ, এ সময় মায়েরা সংসারের অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকেন। চার বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু রোধে প্রয়োজন সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান। চার বছরের অধিক বয়সী শিশুদের সাঁতার শিখিয়ে ডুবে মরা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
প্রশিক্ষণের শুরুটা হয়েছিল সাভারের গেন্ডায় পাঁচটি পুকুর নিয়ে। এরপর ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা দেশে। ২২ জেলায় এখন পর্যন্ত পাঁচ লাখ শিশুকে সাঁতার শেখানো হয়েছে।
সাধারণত একজন মানুষ ৩০ সেকেন্ড গভীর পানিতে ভেসে থাকতে পারলে এবং পানিতে ২৫ মিটার এগিয়ে যেতে পারলে তিনি সাঁতার জানেন বলে ধরে নিতে হবে।
প্রথম আলোর সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি এনামুল হক ও রায়গঞ্জ প্রতিনিধি সাজেদুল আলম জানান, এই দুই উপজেলায় প্রতিবছর গড়ে ১৪০টি শিশু পানিতে ডুবে মারা যেত। কিন্তু সাঁতার প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার পর এখন এ সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত দুই বছরে এই উপজেলার ধানগড়া ইউনিয়নে ২০টি সুইমিংপুলে ২ হাজার ৯৭ জনকে সাঁতার শেখানো হয়েছে।
ইউনিয়নের গৃহবধূ মরিয়ম পারভীন বলেন, সিআইপিআরবি সাঁতারের কর্মসূচি চালু করার আগে এসব বিষয়ে তাঁদের কোনো ধারণা ছিল না।
সাঁতারের প্রশিক্ষক মাসুমা খাতুন বলেন, ‘আমরা শিশুদের বাঁচাতে সাঁতার শেখাচ্ছি।’
শুরুতে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বিস্তৃত হতে থাকলেও এখন আর্থিক সংকটে বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ঢাকার আগারগাঁওয়ের তালতলায় লায়ন্স অগ্রগতি শিক্ষানিকেতন ও আশকোনার আমতলা, বরগুনা ও সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে কর্মসূচি চালু আছে। কক্সবাজারের বাহারছড়ার পুলটি এ মাসে আবার চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
সিআইপিআরবির পরিচালক ও শিশুমৃত্যুবিষয়ক গবেষক আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, একটি পুকুরে বছরে ১০০ জনকে সাঁতার শেখানো সম্ভব। সাঁতার শেখানোর পাশাপাশি পানিতে ডুবে যাওয়ার পর উদ্ধার করা মানুষকে কীভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হয়, সেই প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। উদ্ধার করা শিশুকে প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়ে অনেকে হাসপাতালে ছোটেন। এ কারণে বেশির ভাগই বাঁচে না। সিআইপিআরবির প্রশিক্ষিত লোকেরা এ পর্যন্ত ১৬ শিশুকে মুখে অক্সিজেন দিয়ে এবং পাঁচজনকে পাঁজরের ওপর চাপ দিয়ে প্রাণে বাঁচিয়েছেন।