জীবন সংগ্রামে সহযাত্রী তিন বন্ধুর এমন মৃত্যু!

ছোটবেলায় মা হারানো তরুণ নেজাম উদ্দিন (২৯) চট্টগ্রাম শহরে এসে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন। মিনারেল ওয়াটারের একটি ছোট প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি করতেন। চাকরির পাশাপাশি ফুটপাতে কাপড়ও বিক্রি করতেন। সেই ব্যবসার অংশীদার ছিলেন তাঁর বন্ধু কামরুল ইসলাম (২৬)। নেজামের আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু রেজাউল করিমেরও (২৪) কষ্টের সংসার। আগ্রাবাদ এলাকায় ফুটপাতে বিরিয়ানি বিক্রি করে তাঁর সংসার চলত। জীবন সংগ্রামে পরস্পরের সহযাত্রী ছিলেন তাঁরা। কিন্তু জীবনের শেষযাত্রা চিরতরে থামিয়ে দিল তাঁদের।

গত বৃহস্পতিবার রাতে তিন বন্ধু নগরের এ কে খান এলাকায় একটি বিয়ের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে মোটরসাইকেলে ফেরার পথে গতকাল শুক্রবার ভোর তিনটায় নগরের জাকির হোসেন সড়কের শহীদ লেন এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ হারান।

দুর্ঘটনায় নিহত নেজাম উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রমের সাতকানিয়ার ঢেমশা চৌধুরীহাটে। দেড় বছরের মেয়ে নিগারকে নিয়ে সেখানে থাকতেন নেজামের স্ত্রী নার্গিস আক্তার। নগরের আগ্রাবাদ এলাকার একটি বাড়ির এক কক্ষে একাই থাকতেন নেজাম। সকালে তাঁর গ্রামের বাড়িতে দুর্ঘটনার খবরটি পৌঁছালে মেয়েকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেন স্ত্রী নার্গিস আক্তার। সঙ্গে নেজামের বাবা আবদুর রাজ্জাক ও অন্যান্য স্বজনেরাও ছিলেন।

গতকাল সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে এসেই মূর্ছা যান নার্গিস আক্তার। চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে তাঁকে শুশ্রুষা দেন স্বজনেরা। জ্ঞান ফিরলে বিলাপ করতে করতে নার্গিস বলেন, ‘কাল রাত ১২টায় ফোনে শেষ কথা হয়েছে। বলল, ঘুমাতে যাচ্ছি। কিন্তু এরপর কোথায় গেল, কেন গেল...’

চমেক হাসপাতালের মর্গে নেজাম উদ্দিন এবং তাঁর দুই বন্ধু কামরুল ইসলাম ও রেজাউল করিমের মৃতদেহ সারি করে রাখা। মর্গের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন নেজামের শোকাহত স্বজনেরা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছিলেন রেজাউলের চাচা আবদুর রব। কিন্তু সবার কান্না ছাপিয়ে শোনা যায় নেজামের স্ত্রী নার্গিস আক্তারের বিলাপ। মায়ের এমন কান্না দেখে ছোট্ট নিগারও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। সে কী হারিয়েছে তা এখনো বোঝার বয়স হয়নি। তবু মায়ের শোক যেন স্পর্শ করেছে তাকেও।

নেজামের বাবা আবদুর রাজ্জাক বলেন, পড়ালেখা বেশি করেনি নেজাম। কিন্তু খুব কর্মঠ ছিল। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিল। ৮-৯ বছর হলো সংসার জীবন শুরু করেছে। এখন তার পরিবারের কী হবে? কে দেখবে তাদের?

নিহত রেজাউল করিমের বাড়ি বাগেরহাটে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে বোনের বাসায় থাকতেন তিনি। আর ফেনীর ছাগলনাইয়া এলাকার বাসিন্দা কামরুল ইসলামও আগ্রাবাদেরই একটি মেসে থাকতেন। শুক্রবার মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিলেন রেজাউল। বাড়ি দূরে হওয়ায় এই দুজনের আত্মীয়-স্বজন তেমন আসেননি।

রেজাউলের চাচা আবদুর রব বলেন, রেজাউলেরা তিন বোন ও দুই ভাই। সে ফুটপাতে ব্যবসা করত। তার মা-বাবা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। ঈদে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু আর যাওয়া হলো না।

ঈদে নেজামেরও বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। ৩ আগস্ট নেজাম শেষবারের মতো বাড়ি গিয়েছিলেন। রাতটা থেকে পরদিন সকালেই কর্মস্থলে ফিরেছিলেন। মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে সে কথাই বারবার বলছিলেন তাঁর স্ত্রী নার্গিস। তিনি বলছিলেন, ‘কোরবানির ঈদে বাড়ি যাওয়ার কথা। মেয়েকে দেখে রাখতে বলেছেন তিনি। কিন্তু আমি এখন কোলের বাচ্চাটি নিয়ে কোথায় যাব? কী বলে সান্ত্বনা দেব তাকে!’