জেলা জজদের পদমর্যাদা এখন ৮ ধাপ ওপরে ও সচিবদের সমান

অবশেষে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পদক্রমে (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) জেলা জজরা সাংবিধানিক পদমর্যাদাসম্পন্ন বিবেচনায় সরকারের সচিবদের সঙ্গে ১৬ নম্বর ক্রমিকের মর্যাদায় অবস্থান করবেন। বর্তমানে তাঁরা জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে ২৪ ক্রমিকে আছেন। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বিষয়ে আজ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া মূল রায় লিখেছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন বিচারপতি এস কে সিনহা (বর্তমান প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন আহমেদ চৌধুরী।
আপিল বিভাগের রায়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পদক্রমে স্বাধীনতা পদক, একুশের পদক এবং মহান স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণের কারণে যেসব মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন, তাঁদেরও যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা সমীচীন বলে রায়ে প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে।
২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট আট দফা নির্দেশনাসহ ১৯৮৬ সালের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স (সংশোধিত) অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ২০১১ সালে আপিল করে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে নিযুক্ত বিশেষ কৌঁসুলি আবদুর রব চৌধুরী শুনানি করেন। রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান। এরপর আজ পূর্ণাঙ্গ রায় বেরোল।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী ১৯৮৬ সালে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরি করে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তা জারি করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে তা সংশোধন করা হয়। সংশোধিত এই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিটটি করা হয়। কিন্তু ওই সময় বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব মো. আতাউর রহমান ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরির ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদ, সাংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত ও সংজ্ঞায়িত পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিচের ক্রমিকে রাখা হয়েছে বলে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৬ সালে রিটটি করেন।
আপিল বিভাগের রায়ে হাইকোর্টের আট দফা নির্দেশনা কিছুটা সংশোধন করে তিন দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে—১. যেহেতু সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন, তাই বিরোধপূর্ণ প্রিসিডেন্সে সাংবিধানিক পদধারীরা অগ্রাধিকার পাবেন। ২. জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্য হিসেবে জেলা জজ ও সমপদমর্যাদাসম্পন্নরা সরকারের সচিবদের সঙ্গে ১৬ নম্বরে অবস্থান করবেন। ৩. জেলা জজদের পরেই অতিরিক্ত সচিবেরা ১৭ নম্বর ক্রমিকে থাকবেন।
আমরা স্মরণ করতে পারি, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স নিয়ে বহু মত-দ্বিমত রয়েছে। বিশেষ করে জনপ্রশাসন ক্যাডারের মধ্যে এ নিয়ে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অতীতে লক্ষ করা গেছে। পত্রপত্রিকায় নানা তর্কবিতর্কও হয়েছে। আমরা আশা করব, সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ের মধ্য দিয়ে এখানেই এ-সংক্রান্ত বিতর্কের অবসান ঘটবে। রাষ্ট্রের পক্ষে রিভিউ করার মতো প্রবণতা না দেখালেই আমরা খুশি হব।
টীকা: কেবিনেট বিভাগের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখলাম, ১৯৮৬ সালের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স, যেটি ২০০৩ পর্যন্ত সংশোধিত, সেখানে জেলা ও দায়রা জজদের ২৪ নম্বরে রাখা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সমমর্যাদাসম্পন্ন বিবেচনায় কমান্ড্যান্ট মেরিন একাডেমি, জেলা প্রশাসক, ডিআইজি, এমনকি বিএসটিআইয়ের পরিচালকের পরে আছেন জেলা ও দায়রা জজ। একবার এ বিষয়ে প্রশ্ন করে জবাব পেয়েছিলাম, ইংরেজি বর্ণানুক্রমের রীতি মেনে লেখার ফলে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। জেলা শহরগুলোতে কোনো সভা-সমিতিতে ডিসিরা যতটা উজ্জ্বল থাকেন, জেলা ও দায়রা জজরা সে তুলনায় থাকেন ম্লান। এ বিষয়টি দীর্ঘকাল বিচারকদের মনঃপীড়ার কারণ হয়ে ছিল।
আমার বিবেচনায় অন্য সবার ক্ষেত্রে ওই অদ্যক্ষরের নিয়ম মানা হলেও এবারে আর সেই রীতি খাটবে না। বর্তমানে ১৬ নম্বর ক্রমিকটি আছে এভাবে: 16. Chairman, Public Service Commission. Chairman, University Grants commission. Inspector General of Police. Members, Planning Commission. Officers of the rank of Major General in the army and equivalent in the Navy and the Air force. Secretaries to the Government including Secretary to the Parliament.
ফলে আমার ধারণা, এখন যেভাবে সচিবদের রাখা হয়েছে, এরপরে জেলা জজদের বসালে তাতে আপিল বিভাগের রায়ের ১ নম্বর নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটবে। কারণ, সাংবিধানিক পদধারীদের অগ্রাধিকারে রাখাটাই এখন দেশের আইন। সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এটাই এখন এ বিষয়ে চূড়ান্ত আইন। তাই ‘ডিস্ট্রিক্ট অ্যান্ড সেশন জজ’ কথাটি ‘সেক্রেটারিজ’ কথাটির আগে বসবে।