জোরালো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের অনশনে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অসুস্থ এক শিক্ষার্থীকে শুশ্রূষা দিচ্ছেন সহপাঠীরা। বৃহস্পতিবার সকালে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে
ছবি: আনিস মাহমুদ

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে চলা আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ আরও বেড়েছে। দাবি আদায়ে শিক্ষার্থীদের একাংশ বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনের মতো আমরণ অনশন অব্যাহত রাখেন।

শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে তাঁদের আন্দোলনের অষ্টম দিন বৃহস্পতিবার সিলেট শহরে একাধিক সংগঠন কর্মসূচি পালন করেছে। এতে ওই আন্দোলন আরও জোরালো হয়েছে।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা গত মঙ্গলবার রাতে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনকে গত বুধবার দুপুর ১২টার মধ্যে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলেন। পদত্যাগ না করায় ওই দিন দুপুরের পর উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অনশন শুরু করেন ২৪ জন ছাত্রছাত্রী। বৃহস্পতিবার রাত দেড়টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অনশন চলছিল। তবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ছয়জনকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর বাইরে একজন অনশনকারী ছাত্রের পরিবারের এক সদস্য হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি ভোরে বাড়িতে গেছেন।

এদিকে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে ১টা ১০ মিনিট পর্যন্ত কয়েক শ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে মশাল মিছিল করেন।

শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে অনশন চালিয়ে যাওয়ায় অংশগ্রহণকারীদের অনেকের জ্বর দেখা দেওয়ার পাশাপাশি রক্তচাপ কমে অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। অসুস্থ হয়ে পড়ায় নয়জনের শরীরে স্যালাইন পুশ করেছেন চিকিৎসকেরা। তবে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনশন চলবে।

বিগত কয়েক দিনের ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবারও সিলেট শহরে একাধিক নাগরিক সংগঠন উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। বিকেলে জজকোর্টের সামনে শাবিপ্রবির সাবেক শিক্ষার্থী ও আইনজীবীদের উদ্যোগে এবং সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে প্রগতিশীল ছাত্র জোটের মানববন্ধন হয়েছে। বিকাল সাড়ে চারটার দিকে সিলেট মহানগর বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করে।

এ ছাড়া বিকেলে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়েছেন দেশ ও বিদেশে অবস্থানরত সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২৫ বিশিষ্ট নাগরিক। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে যৌক্তিক উল্লেখ করে তাঁরা বলেছেন, ‘উপাচার্য, শিক্ষকনেতা, রাজনৈতিক নেতা আর ছাত্রনেতাদের দাবা খেলার সময় এখন নয়। আমাদের সন্তানেরা উন্মুক্ত আকাশের নিচে অনশন করছে। তাদের উন্মুক্ত আকাশের নিচে অভুক্ত রেখে আমরা সুখনিদ্রায় যেতে পারি না।’

বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন আইনজীবী তবারক হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ বজলুল করিম, স্থপতি জেরিনা হোসেন, আইনজীবী ইরফানুজ্জামান চৌধুরী ও এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম, নাগরিক সংগঠক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী ও আবদুল করিম চৌধুরী (কিম), নাট্যব্যক্তিত্ব মিশফাক আহমদ চৌধুরী প্রমুখ।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সূত্রপাত ১৩ জানুয়ারি। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েক শ ছাত্রী। শনিবার সন্ধ্যার দিকে ছাত্রলীগ ছাত্রীদের আন্দোলনে হামলা চালায়।

পরদিন বিকেলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন। তখন পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা ও তাঁদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। ওই দিন রাত সাড়ে আটটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা ও শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। শাহজালালে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, খুলনা, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন নাগরিক ও রাজনৈতিক সংগঠন।

এদিকে বুধবার রাতের মতো বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় ও ২টায় শাবিপ্রবির শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধিদল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে যায়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ না করলে কোনো আলোচনাতে বসবেন না বলে তাঁদের জানান।

শরীর নেতিয়ে এলেও মনোবল ভাঙেনি

অনশনে বসা শিক্ষার্থীদের শরীর নেতিয়ে এলেও মনোবল ভাঙেনি বলে দাবি করেছেন তাঁরা। তাঁদের একজন বলেন, বুধবার বেলা তিনটার কিছু আগে অনশন শুরু হয়। প্রথম ছয়-সাত ঘণ্টা তেমন সমস্যা হয়নি। রাত ১০টার দিক থেকে পানির পিপাসা বাড়তে থাকে। অন্যদিকে তাপমাত্রাও কমছিল। গভীর রাতে অসুস্থতা দেখা দেয়। শরীরের তাপমাত্রার পাশাপাশি রক্তচাপও কমে যায়।

আরেক ছাত্র বলেন, গভীর রাতে ঠান্ডা বেড়ে অনশনরত এক শিক্ষার্থীর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এ সময় কোনো চিকিৎসকও ছিলেন না। পরে অন্য শিক্ষার্থীরা তাঁকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করেন। ভোরে আরেক অনশনকারীর বমি শুরু হয়।
অনশনে অংশ নেওয়া এক ছাত্রী বলেন, ঠান্ডায় অনেকের জ্বর দেখা দিয়েছে। তিনিসহ

কয়েকজন স্যালাইন নিচ্ছেন। কয়েক দিন ধরে চলা আন্দোলনে মনোবল না ভাঙলেও শরীর আর চলছে না। এরপরও আমরণ অনশন চলবে তাঁদের।

‘আগুনে ঘি না ঢালার’ আহ্বান পরিকল্পনামন্ত্রীর

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বৃহস্পতিবার সকাল নয়টায় সিলেট নগরের পাঠানটুলা এলাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, তাঁরা (শিক্ষার্থীরা) কম বয়সের, কোমলমতি, একটু উত্তেজনা থাকে। একটু সময় দিয়ে বুঝিয়ে কথা বলে তাঁদের নিয়ে সমাধান করা সম্ভব। কোনো হঠকারী কাজ কোনো মহলেই, কারও পক্ষ থেকেই যেন না হয়। আগুনে যেন ঘি ঢালা না হয়। ধৈর্যের সঙ্গে বুঝিয়ে এটা মোকাবিলা করতে হবে। শাবিপ্রবির ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সমাধানের জন্য প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছেন। তাঁরা খোঁজখবর নিচ্ছে ও সমাধানের চেষ্টা করছে।

শাহজালালের ভিসির মন্তব্য প্রত্যাহার চান জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষকেরা
প্রতিনিধি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আপত্তিকর মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ।

বৃহস্পতিবার এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি লায়েক সাজ্জাদ এন্দেল্লাহ ও সম্পাদক মোতাহার হোসেন এবং বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের সভাপতি অজিত কুমার মজুমদার ও সম্পাদক খালিদ কুদ্দুস স্বাক্ষরিত পৃথক দুটি বিবৃতিতে এ প্রতিবাদ জানানো হয়।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন করছেন। এরই মধ্যে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। তাঁর ওই মন্তব্যের প্রতিবাদে বুধবার ফরিদ উদ্দিনের কুশপুত্তলিকা দাহ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা।

শিক্ষক সমিতির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা অত্যন্ত অবমাননাকর ও অসম্মানজনক। আমরা আশা করি, তিনি প্রকাশ্যে তাঁর ভুল স্বীকার করে অশোভন মন্তব্য প্রত্যাহার করবেন।’

এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়, উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে অবমাননাকর ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। ওই মন্তব্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে।

‘ছাত্রছাত্রীদের জীবনের চেয়ে কি উপাচার্যের চাকরি রক্ষা বড়?’

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রসঙ্গে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, আমরণ অনশনরত শত শত ছাত্রছাত্রীর মূল্যবান জীবনের চেয়ে উপাচার্যের চাকরি রক্ষা অতি গুরুত্বের কেন হবে। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি ছাত্রদলের
প্রতিবেদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জানান, উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের পদত্যাগকে ‘শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি’ বলে মন্তব্য করেছেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফজলুর রহমান। ফরিদ উদ্দিন পদত্যাগ না করলে বর্তমান সরকারের পদত্যাগের দাবিতে সারা দেশে ‘উত্তাল আন্দোলন’ গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।

বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এক প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নিয়ে ছাত্রদল সভাপতি এ হুঁশিয়ারি দেন। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ ও শিক্ষার্থীদের নামে দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ছাত্রদল এ কর্মসূচির আয়োজন করে।

‘উপাচার্যের পদত্যাগ চায় ছাত্র ফ্রন্টও’

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সমাবেশ করেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী)। বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এ সমাবেশ হয়।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের উদ্বেগ

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে ফেডারেশন এ উদ্বেগ জানায়।

অধ্যাপক ফরিদা ইয়াসমিন বারী ও অধ্যাপক মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট হলে নতুন প্রভোস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তারপরও একটি মহল শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে।