জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পুলিশে চলতি দায়িত্ব
পুলিশ কর্মকর্তাদের চলতি দায়িত্বের পদায়ন বাতিল করতে বলেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে চলতি দায়িত্ব দিয়ে কিছু কর্মকর্তাকে উচ্চতর পদে বসানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় এঁদের নিয়োগ বাতিল করে নিয়মিত কর্মকর্তার সেই পদে দেওয়ার প্রস্তাব পাঠাতে বলেছে।
বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে চলতি দায়িত্বের কর্মকর্তা আছেন। এসব কর্মকর্তাকে চলতি দায়িত্বে নিয়োগ অর্থাৎ পদোন্নতি ছাড়াই কোনো কর্মকর্তাকে এক ধাপ ওপরের পদে বসানো নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের ভেতরেই বিরূপ সমালোচনা রয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) আতিকুল ইসলামকে ডিআইজির চলতি দায়িত্ব দিয়ে নৌ-পুলিশের প্রধান হিসেবে পদায়নের প্রস্তাব করা হয়। নৌ-পুলিশের ডিআইজির পদটি নতুন পদ। কিছুদিন আগে ওই পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুযায়ী নতুন সৃষ্টি হওয়া পদে চলতি বা অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়ার কোনো বিধান নেই। তার পরও পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ ধরনের প্রস্তাব পাঠানোর কারণে ক্ষুব্ধ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুসারে নতুন পদে চলতি দায়িত্ব বা অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়ার বিধান না থাকায় এ প্রস্তাব করা সম্ভব নয়। পুলিশ বিভাগের ডিআইজি পদের পদোন্নতি উচ্চপর্যায়ের পদোন্নতিসংক্রান্ত কমিটির (সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড—এসএসবি) মাধ্যমে হয়ে থাকে। এমন একটি উচ্চ পদে পদায়নের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা অনুসরণ করতে হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানায়, শুধু একটি প্রস্তাবেই নয়, এর আগে পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত ডিআইজি, ডিআইজি, পুলিশ কমিশনারসহ বিভিন্ন পদে চলতি দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিজেদের লোকদের পছন্দের পদে বসানোর জন্য এর আশ্রয় নেওয়া হয়। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার ও সিআইডি প্রধান পর্যন্ত চলতি দায়িত্বে কর্মকর্তা ছিলেন। সম্প্রতি তাঁরা পদোন্নতি পেয়েছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে পুলিশ ক্যাডারের ১২তম ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তাকে চলতি দায়িত্বে ডিআইজির পদে বসানো হয়েছে। আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে এ পদে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ পদ্ধতিতে নিয়োগ দেওয়াকে অনিয়ম উল্লেখ করে বলেছেন, এত দিন দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার সংস্কৃতি চালু থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ প্রশাসনে এই অনিয়ম শুরু হয়েছে।
এভাবে নিয়োগ পাওয়া সবচেয়ে সৌভাগ্যবান কর্মকর্তা হলেন, পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (চলতি দায়িত্বে) প্রলয় কুমার জোয়ারদার। ২৪তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশে আসা এই কর্মকর্তা শতাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে এআইজির চলতি দায়িত্বে নিয়োগ পেয়েছেন। এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রটোকল কর্মকর্তা ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল কর্মকর্তা থাকতেই পুলিশে বেশ প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল তাঁর। পরে ওই পদ থেকে সরিয়ে তাঁকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার করা হয়। এখন উচ্চ পদের সব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন তিনি।
এ রকম আরেকজন কর্মকর্তা হলেন ১৯৯১ ব্যাচের হাসানুল হায়দার। এপিবিএন কমান্ড্যান্ট থাকার সময় তাঁকে বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়। পরে তিনি এই আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে যান। কিছুদিন আগে তাঁকে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদে চলতি দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে মন্ত্রণালয় তা ফিরিয়ে দেয়।
আরেক কর্মকর্তা মিজানুর রহমানকে সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার হিসেবে চলতি দায়িত্ব নিয়োগ দেওয়া হয়। এ পদের জন্য ২৫ কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা হয়।
১৯৮৬ সালের ব্যাচের একজন জ্যেষ্ঠ ডিআইজি সোহরাব হোসেনকে সরিয়ে ১৯৯১ সালের ব্যাচের কামরুল ইসলামকে রেলওয়ে পুলিশের ডিআইজি চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৮৯ সালের ব্যাচের অনেক কর্মকর্তা এখনো ডিআইজি পর্যন্ত হতে পারেননি।
সূত্রগুলো জানায়, গত ২০১১ সালের ৬ জুলাই বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে মারধর করে আলোচনায় আসেন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত উপকমিশনার হারুন অর রশীদ ও সহকারী কমিশনার বিপ্লব সরকার। গত বছরের মাঝামাঝি ৪৩ জনকে ডিঙিয়ে হারুনকে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তিনি এখন ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার। একইভাবে বিপ্লব সরকারকে এক বছরের মাথায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থেকে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তিনি এখন তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার।
পুলিশ সূত্র জানায়, বিসিএস ২০ ব্যাচের ৩০ কর্মকর্তাকে বাদ দিয়েই ২১ ব্যাচের বিপ্লব সরকারসহ দুই কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অথচ এখন পর্যন্ত বিসিএস ১২তম ব্যাচের ১৩ জন ও ১৫তম ব্যাচের ১২ কর্মকর্তা পুলিশ সুপার থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।
চিঠিতে বলা হয়েছে, যেসব কর্মকর্তাকে নতুন পদে চলতি দায়িত্ব বা অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে যাঁদের উচ্চতর পদে বসানো হয়েছে, তাঁদের পরিবর্তে নতুন করে নিয়মিত কর্মকর্তার মনোনয়ন পাঠাতে হবে।