টিপের ঘটনা জানান দিচ্ছে, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়তে আমরা কতটা ব্যর্থ: সুলতানা কামাল

সুলতানা কামাল
ফাইল ছবি

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের সভাপতি। তিনি টিপ পরা নিয়ে ঢাকার রাস্তায় এক নারীর নিগ্রহের শিকার হওয়া নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর প্রতি সহিংসতা ও পরমতসহিষ্ণুতার প্রশ্নগুলো নিয়েও কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: টিপ পরা নিয়ে রাজধানীর রাস্তায় প্রকাশ্যে নিপীড়নের শিকার হলেন একজন নারী। এখানে অভিযোগ একজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। কী বলবেন এ পরিস্থিতি নিয়ে?

সুলতানা কামাল: এ ধরনের ঘটনা যে এই প্রথম ঘটল, তা নয়। এ ক্ষেত্রে লতা সমাদ্দার প্রতিবাদী হয়েছেন বলে বিষয়টা সবার সামনে এল। দুঃখজনকভাবে আবারও প্রতীয়মান হলো, আমাদের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও জাতি, ধর্ম কিংবা যেকোনো পরিচয়নির্বিশেষে সেবা প্রদান ও সম্মান প্রদর্শনের নিরপেক্ষ মানসিকতা ও সংস্কৃতিবোধের কী প্রকট অভাব বিদ্যমান। একটি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়তে আমরা কতটা ব্যর্থ, এ ঘটনা সেটাই জানান দিচ্ছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ঘরের বাইরে ঢাকা শহরে এবং সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অন্যত্রও নারীর জন্য সহায়ক পরিবেশ কি আছে? প্রতিবন্ধকতাগুলো কী কী?

সুলতানা কামাল: নারীর প্রতি সহিংসতার যে পরিসংখ্যান প্রতিদিন আমাদের কাছে আসে, তার ওপর ভিত্তি করে দুঃখজনকভাবে বলতেই হয় যে ঘরে-বাইরে, শহরে-গ্রামে দিনে–রাতে কোথাও নারীর জন্য সার্বিকভাবে সহায়ক পরিবেশ নেই। এখনো আমাদের নিরাপত্তা আর সমান সুযোগের দাবিতে রাস্তায় নামতে হয়। এর পেছনের মূল কারণ হলো ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র নারীর সম–অধিকার ও সমমর্যাদার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখে না। বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর আত্মপ্রকাশ ও অবস্থান পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারার ধারক–বাহকদের কাছে এখনো অগ্রহণযোগ্য রয়ে গেছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বা নানা পরিস্থিতির চাপে যদিও নারীর অধিকারকে তাত্ত্বিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে, তবে সার্বিকভাবে নারীর ব্যক্তিসত্তাকে মেনে নিয়ে তাঁকে মানুষ হিসেবে তাঁর পূর্ণ মর্যাদায় পাশে স্থান দেওয়ার সামাজিক মনন ও মানসিকতা গড়ে তোলার কাজে যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে রাজনৈতিক সুবিধাবাদের কৌশলের কারণে ধর্মানুভূতির দোহাই দিয়ে নারীবিদ্বেষী মনোবৃত্তিকে অনবরত প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। আমরা হতাশ হই দেখে যে নারী স্বাধীনতা এবং নারীর সম-অধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো এবং একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনাকেই মূলত ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করাকে রাজনীতির রীতি হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আমরা সামাজিক নানা সূচকে এগোচ্ছি। নারীর সামাজিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে কিছু অর্জন আমাদের আছে। তারপরও নিগ্রহের ঘটনাগুলো বাড়ছে কেন?

সুলতানা কামাল: ক্ষমতায়নের তো নানা ধাপ রয়েছে। এক থেকে দুইয়ে পৌঁছালেও সেটা এগোনো। সেটাও অর্জন বলেই চিহ্নিত হবে। কিন্তু আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা থেকে কত দূরে আছি, সেটাও বিচার্য। শুধু নারীর অবস্থানগত কিছু পরিবর্তন আনলেই নারীর স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। নারীর অগ্রসর হওয়ার অন্যতম ফল পরিবারে, সমাজে নারীর পরিবর্তিত ভূমিকা। পেশাজীবী, রাজনীতিক, সমাজে নেতৃত্ব দেওয়ার অবস্থানে নারীর উপস্থিতি এবং দৃশ্যমান হওয়া। একসময় নারীর পরিচয় ছিল ‘নারী সাত চড়ে রা করে না’। এখনকার নারী অনেক অধিকারসচেতন। নারী প্রতিবাদ করতে জানেন, অধিকার দাবি করতে জানেন, অধিকার ভোগ করার নিশ্চয়তা চান। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ, বিশেষত পুরুষ যদি তা গ্রহণ এবং মেনে নেওয়ার দীক্ষায় দীক্ষিত না হন, তাহলে নারী নতুন করে আরও প্রকট আক্রমণ ও নিগ্রহের শিকার হন। আমাদের সমাজে তাই ঘটে চলেছে। সংবিধান নারীকে জনজীবনের সর্বত্র সমান অধিকার দিয়েছে কিন্তু ব্যক্তিজীবনে নারীকে পুরুষনির্ভর এবং পুরুষের নিয়ন্ত্রণেই রাখা হয়েছে। এখন পর্যন্ত নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি সত্ত্বেও নারীর প্রতি চরম বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন পরিবর্তন করা হয়নি, নারীনীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন থমকে আছে। বারবার কথা দিয়েও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকারও সিডও সনদের ধারা ২ এবং ১৬ (১) গ–এর সংরক্ষণ তুলে নেয়নি। বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন করেনি। অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর সম-অধিকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থনের অভাব থাকাতে পুরুষতান্ত্রিক নারীবিদ্বেষী আচরণ প্রতিহত করতে পারছি না আমরা।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে। নিপীড়নের ক্ষেত্রে অনেক সময় রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরা জড়িত হয়ে পড়েন। তাঁদের বিরুদ্ধে কতটুকু ব্যবস্থা নেওয়া হয়?

সুলতানা কামাল: আমরা যদি নারী নির্যাতন মামলায় বিচারের হিসাবটা দেখি, সহজেই এই প্রশ্নের উত্তর পেতে পারি। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তাতে জানতে পারি যে নারী নির্যাতন মামলায় বিচার পাওয়ার হার হচ্ছে ৩ শতাংশের কাছাকাছি, যার মধ্যে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত ঘটনাও আছে। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখি, এ ধরনের অভিযুক্ত ব্যক্তির বিষয়ে প্রথমে অস্বীকৃতির কৌশল গ্রহণ করা হয়, না হলে হয় তাঁদের অন্যত্র বদলি করা হয় কিংবা হেডকোয়ার্টারে ফেরত নিয়ে আসা হয়। দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা বিরল।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আচরণসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ, মানবাধিকার বিষয়ে শিক্ষাদানের গুরুত্ব যথেষ্ট। এসব কতটুকু মেনে চলা হয়?

সুলতানা কামাল: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জেন্ডার প্রশিক্ষণ বা মানবাধিকারের ওপর প্রশিক্ষণের নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে দেশি-বিদেশি সহযোগিতায়। যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই এসবের আয়োজন করা হয়েছে। একটা সময় বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনকেও প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। কিছু কিছু মডেল থানা ও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নিগৃহীত নারীরা ভালো আচরণ পেয়েছেন, আমার অভিজ্ঞতায় মানবাধিকারের কাজে পুলিশ বাহিনীর অনেকের উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা পেয়েছি। তবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিনির্ভর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই প্রশিক্ষণের গভীর, সুদূরপ্রসারী বা ব্যাপক কোনো প্রভাব সাধারণভাবে বাহিনীর সদস্যদের আচরণে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় না। ইদানীং আন্দোলনরত কিছু নারী ভুক্তভোগী জানান, নারী-পুরুষনির্বিশেষে পুলিশ সদস্যরা তাঁদের যেভাবে শারীরিক আঘাত করেন, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতার মতো বিষয়গুলো আমাদের পাঠ্যক্রমে কতটুকু আছে? সহনশীল সমাজ গড়ার শর্তগুলো কতটুকু পূরণ হচ্ছে?

সুলতানা কামাল: আমরা পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বা পরমতসহিষ্ণুতার বিষয়সংক্রান্ত মূল্যবোধগুলোর উৎকর্ষ সাধনে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হতে দেখেছি। আর তার ফলে একটা সার্বিক প্রভাব বিস্তার ঘটতে দেখেছি। কিন্তু এখন তার খুব অভাব বোধ করি। এখন রাজনীতি ক্ষমতাকেন্দ্রিক চরিত্র ধারণ করেছে। কৌশল হিসেবে তারা, এমনকি প্রগতিশীল দলগুলোও সংকীর্ণ সহিংস জঙ্গিবাদী ধর্ম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আপসের নীতিকে অনুসরণ করে চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা তাদের নিজেদের ঘোষিত অঙ্গীকার বিসর্জন দিয়ে উল্টা পথে চলেছে। তার একটা প্রভাব সমাজের ওপর গিয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র ও সমাজে যদি মুক্তবুদ্ধিচর্চার সমর্থন না থাকে, ব্যক্তিজীবনও সংকুচিত হতে থাকে। পক্ষান্তরে উচ্চাভিলাষী, স্বার্থকেন্দ্রিক বিভাজনের চিন্তাধারা ও মানসিকতা সমাজকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ভিন্নতাকে গ্রহণ করার ক্ষমতা লুপ্ত হতে থাকে। পাঠ্যক্রমে সময়ে–সময়ে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা বিধৃত করার চেষ্টা করা হয়েছে, তবে প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির দাপটে তা থেকে সরে আসা হয়েছে। আমরা তো একমুখী শিক্ষার নীতি ধরে রাখতে পারিনি।