ডায়াসপোরার উজ্জ্বল সন্তান

ফোর্বসের অনুষ্ঠানে সাজ্জাদ হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

বেশ কিছুদিন আগের কথা। ২০০৯ সালে সিঙ্গাপুরে কর্মরত বাংলাদেশের এক দক্ষ কর্মী, ৩৫ বছরের সারওয়ার তাঁর হাতটা চিরতরে হারালেন। সারওয়ার লেখাপড়া মোটামুটি জানতেন, তবে ইংরেজিটা পারতেন না ভালোভাবে। তাই ইংরেজিতে লেখা নির্দেশিকা ঠিকমতো না পড়েই হাত ঢুকিয়ে এয়ারকন্ডিশন গ্যাস লিকেজ বন্ধ করতে গিয়ে নিজের জীবনে ডেকে আনলেন ঘোর অমানিশা। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি ডায়াসপোরা সন্তান সাজ্জাদ হোসেন খুব কাছ থেকে দেখেছিল ঘটনাটা। তার কিশোর মন দারুণভাবে ধাক্কা খেয়েছিল।

অধিকাংশ পেশাজীবী বাংলাদেশি যেখানে পথেঘাটে বাংলাদেশের শ্রমিকদের বাগানে, রাস্তাঘাটে বা দোকানে কাজ করতে দেখলে পাশ কাটিয়ে না দেখার ভান করে চলে যান, আরও কঠিনভাবে বললে, তাঁদের নিয়ে লজ্জিত হন, সাজ্জাদ সেখানে ছোট বয়স থেকেই তাঁদের প্রতি অসম্ভব সহানুভূতিশীল, দরদি। শ্রমিকদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে অথবা গন্তব্য চিনিয়ে দিয়ে তাঁদের সহায়তা করে প্রতিনিয়ত।

সাজ্জাদ হোসেন

সিঙ্গাপুরের অভিবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের

ইংরেজি শেখান


জন্ম

১ জানুয়ারি ১৯৯৪, ঢাকা, বাংলাদেশ

সিঙ্গাপুরে গমন

২০০৫

পড়াশোনা

সিঙ্গাপুরের নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে তড়িৎ প্রকৌশলে পড়ছেন

এ পর্যন্ত ইংরেজি শিখিয়েছেন

১৮ হাজার ৫০০ অভিবাসী শ্রমিককে

অর্জন

ফোর্বস সাময়িকীতে এশিয়ার ‘থার্টি আন্ডার থার্টি ২০২১’ তালিকায় স্থান

কিন্তু সারওয়ারের দুর্ঘটনাটা তাঁকে বুঝিয়ে দিল কঠিন সত্য, ইংরেজি নির্দেশিকা পড়ার বিষয়ে আড়ষ্টতা বহু শ্রমিকের জীবনে বয়ে আনছে মর্মান্তিক পরিণতি। সাজ্জাদের মাথায় ঘুরতে থাকে চিন্তা, কী করে এই মানুষদের কর্মক্ষেত্রে এবং চলার পথের প্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দগুলো শেখানো যায়।

ও-লেভেল পরীক্ষার পর নিজের বাসার কাছের পার্কে ছয়জন বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়ে সাজ্জাদ খুলে বসলেন একটি পাঠশালা। প্রথমে টুকরো টুকরো শব্দ, তারপর শব্দ জোড়া দিয়ে বাক্য গাঁথা। এ এক দারুণ খেলা!

খেলার উপযোগিতা অল্পদিনের মধ্যেই টের পেলেন সাজ্জাদ। কোনো বিপণনকৌশল ছাড়াই ছাত্রসংখ্যা এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে পার্ক ছেড়ে আস্তে আস্তে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের শ্রেণিকক্ষে স্থান করে নিল পাঠশালাটি। মানুষকে সহজে ইংরেজি শেখানো আর নিজস্ব পাঠ্যক্রম তৈরির জন্য দেশ-বিদেশের কত পাঠ্যক্রম যে সাজ্জাদ ঘেঁটেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। কোভিড-১৯-এর আগপর্যন্ত তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা সিঙ্গাপুরে কর্মরত ৮ হাজার ৫০০ বাংলাদেশি শ্রমিককে ইংরেজি ভাষায় দক্ষ করে তাঁদের সনদ দিয়েছেন। আর কোভিডের সময় মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে শিখিয়েছেন আরও ১০ হাজার শ্রমিককে।

২০১৩ সালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় সাজ্জাদের এই সামাজিক উদ্যোগ। তিনি গড়ে তোলেন সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এসডিআই) একাডেমি।

মেঘে মেঘে বেলা কেটে গেছে বেশ। কিশোর সাজ্জাদ আজ ২৭ বছরের উদ্যমী তরুণ। ইতিমধ্যে নানইয়াং ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে তড়িৎ প্রকৌশলের ডিগ্রি নিচ্ছেন তিনি। আর এখন তাঁর একাডেমিতে কাজ করছেন ১৮ জন সমাজসেবী।

সাজ্জাদ এখন কেবল ইংরেজিই শেখান না, অভিবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের উন্নতির জন্য করছেন আরও নানা কিছু। যেমন, সিঙ্গাপুরে বিভিন্ন ধরনের সার্টিফিকেট কোর্স রয়েছে, যেগুলো করলে শ্রমিকেরা উন্নত পদসোপানে পা রাখতে পারেন। কিন্তু অভাগা বাংলাদেশি শ্রমিকেরা সেসব তথ্য পাবেন কোথায়? এসডিআই একাডেমি এখন শ্রমিকদের কর্মজীবনের পরিকল্পনাবিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছে। সঙ্গে ইংরেজি শেখানো তো আছেই।

সাজ্জাদ হোসেন মানুষটা আদতে স্বাপ্নিক। তিনি যেমন স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন, তেমন বাস্তববাদী, প্রকৌশলবিদ্যার ছাত্র। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা অসংখ্য। ফলে একা সাজ্জাদের একাডেমিই-বা কতজনকে আর হাতে-কলমে ইংরেজি শেখাতে পারবে। এই সমস্যার সমাধানে এই তরুণ উদ্ভাবন করেছেন কার্যকর এক পদ্ধতি। ‘এসডি একাডেমি’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করেছেন তিনি, যার মাধ্যমে ক্লাস না করেও প্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দ-বাক্য আয়ত্ত করে নিতে পারবেন যেকোনো অভিবাসী। আর এর মধ্যে সাজ্জাদের বিখ্যাত ব্যবহারিক ইংরেজি ভাষা শিক্ষার বই ড. ইংলিশ-এর দুটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। অন্য দেশের শ্রমিকদের ভোগান্তির কথা মাথায় রেখে এখন আরও ছয়টি ভাষায় অনূদিত হচ্ছে বইটি।

সাজ্জাদ হোসেনের গল্প কিন্তু এখানেই শেষ নয়। মেধার সর্বোচ্চ বিকাশে সিঙ্গাপুরে শ্রম অভিবাসীদের সুযোগ রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার। সেই সূত্রে সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব হায়ার লার্নিংয়ের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশি শ্রমিকদের পড়াশোনার জন্য দুটি যুগান্তকারী প্রণোদনা আদায় করে এনেছেন সাজ্জাদ। সিঙ্গাপুরে পড়াশোনার জন্য টিউশন ফি যেখানে ১৮ হাজার ডলার, সেখানে বাংলাদেশের শ্রমিকদের দিতে হবে ৬ হাজার ডলার। এমনকি এই টিউশন ফিও একবারে দিতে হবে না, দেওয়া যাবে ছোট ছোট কিস্তিতে ।

এর সুফল কিন্তু অনেকেই পাচ্ছেন। মাধ্যমিক পাস করে সিঙ্গাপুরে কাজ নিয়ে গিয়েছিলেন এমন ২০০ কর্মী আজ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংসহ আরও নানা বিষয়ে ডিপ্লোমা লাভ করেছেন।

আবার যেসব শ্রমিকের মাধ্যমিক ডিগ্রিও নেই, তাঁদের জন্যও সুযোগ তৈরি করেছেন সাজ্জাদ। ফলে স্থানীয় আইটিই কলেজ সেন্ট্রালে মাধ্যমিকের সমমান সম্পন্ন করে এখন ডিপ্লোমা কোর্সে অংশ নিতে পারেন যেকোনো ইচ্ছুক বাংলাদেশি শ্রমিক।

শ্রমিকদের কল্যাণে শিক্ষাসহ আরও অনেক কিছুই তো করার আছে। এ ক্ষেত্রে সাজ্জাদের আকাঙ্ক্ষা, প্রাক্‌গমন, বিদেশে অবস্থান ও নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন এবং পুনর্বাসন—অভিবাসনের এই তিনটি পর্যায়কেই ধরার। তিনি বললেন, ‘অগ্রণী ব্যাংকসহ সিঙ্গাপুরে অবস্থিত বাংলাদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে এখন আমরা একটা চুক্তিতে আসার চেষ্টা করছি। যাতে আমাদের “এসডি একাডেমি” অ্যাপের মাধ্যমে অভিবাসীরা তাঁদের রেমিট্যান্সও দেশে পাঠাতে পারেন। করোনা বাস্তবতায় এটা কার্যকর করা গেলে অনেক শ্রমিককেই একটা দিন নষ্ট করে ব্যাংক বা রেমিট্যান্স হাউসে গিয়ে আর দেশে টাকা পাঠাতে হবে না।’

সাজ্জাদের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, মনে হচ্ছিল তিনি যেন রবীন্দ্রনাথের মতোই আরেক ‘পাগলা’, যিনি মনটাকে বাঁধতে জানেন না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মনকে বাঁধার চেষ্টা করেছিলেন এই বলে যে ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ...দেখিস যবে প্রভাতবেলা, তুই কেন রে হোস উতলা দেখে মোহন চাঁদ? করুণ সুরে গাইলে পাখি, তোর কেন রে ঝরে আঁখি?’

নিজের ক্যারিয়ার বা মেধার বিকাশে মনটাকে বেঁধে রাখেননি সাজ্জাদ। তিনি বরং তৃপ্তি খুঁজেছেন অবহেলা, অনাদর ও লোকচক্ষুর অন্তরালে পড়ে থাকা অভিবাসী শ্রমিকদের নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়ে।

নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন তিনি দেখান, তাঁকে নিয়েই তো সবাই স্বপ্ন দেখে। তাই বিশ্বখ্যাত মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস প্রকাশিত এশিয়ার ২০২১-এ ৩০ বছরের নিচে ৩০ জনের (থার্টি আন্ডার থার্টি) তালিকায় স্থান পেয়েছেন সাজ্জাদ। তা ছাড়া তাঁর অভিনব উদ্যোগের খবর প্রকাশিত হয়েছে সিঙ্গাপুরের সংবাদমাধ্যম দ্য স্ট্রেইটস টাইমস ও চ্যানেল নিউজ এশিয়ায়। সিঙ্গাপুরের জাতীয় দিবসে তিনি পেয়েছেন ওই দেশের রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণ। সেখানে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং তাঁর কাজের প্রশংসা করেছেন। সাজ্জাদের ভালো কাজের স্বীকৃতি আসতে শুরু করেছে একে একে।

শেষে মন খুলে বলতে চাই—সাজ্জাদ, আপনি এই অল্প বয়সে বাংলাদেশকে যা দিয়েছন, আমরা অনেকেই, আত্মসমৃদ্ধি ঘটিয়েছি ঠিকই, কিন্তু জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসেও তা দিতে পারিনি। একেই আমরা অভিবাসনের ভাষায় বলি, ‘ডায়াসপোরা গিভিং ব্যাক টু দেয়ার প্লেসেস অব অরিজিন’। কোনো উৎস দেশের ব্যক্তি দ্বিতীয় কোনো দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেই আমরা তাকে ডায়াসপোরা বলি না। ডায়াসপোরার অংশ সে তখনই, যখন সে যে দেশে রয়েছে তার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য রেখেও নিজের উৎসরাষ্ট্রের সঙ্গে মানসিক-সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত থাকে। পাশাপাশি অভিবাসনের দেশে অবস্থানরত তার উৎস দেশ থেকে আসা লোকেদের সঙ্গে একধরনের একাত্মতা বোধ করে। চীন যখন ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ গ্রহণ শুরু করে, ৭০ শতাংশ বিনিয়োগই এসেছিল সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা চীনা ডায়াসপোরাদের মধ্যে থেকে। ভারত সরকার মনে করে, বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ভারতীয় ডায়াসপোরারা সেসব দেশে ভারতীয় দূত। আমাদের সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশের এমনই এক উজ্জ্বল ডায়াসপোরা সন্তান।

তাসনিম সিদ্দিকী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক