ডা. কসিরউদ্দিন তালুকদার

স্কেচ: এ এফ এম মনিরুজ্জামান
স্কেচ: এ এফ এম মনিরুজ্জামান

একাত্তরের ২৬ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল রংপুর থেকে বগুড়া শহরের উত্তর প্রান্তে আসে। জনগণের প্রতিরোধের মুখে কয়েক দিন পর তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত বগুড়া মুক্ত ছিল। এরপর পাকিস্তানিরা বগুড়া দখল করে।
চিকিৎসক কসিরউদ্দিন তালুকদার তখন তাঁর গ্রামের বাড়ি দুপচাঁচিয়ার মহিষকুণ্ডে ছিলেন। ২১ মে তিনি শহরের নিজ বাসায় ফেরেন। ২৯ মে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল বাড়িতে এসে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেনারা সেদিনই বগুড়া শহরের দক্ষিণে মাঝিড়ার এক পুরোনো কবরের পাশে নিয়ে তাঁকে হত্যা করে। পরে স্থানীয় গ্রামবাসী তাঁর লাশ শনাক্ত করে সেখানেই সমাহিত করে।
তাঁর বড় মেয়ে গীতিকার জেব-উন-নেসা জামালের রচনা থেকে এ সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘...২১ মে তিনি বগুড়ায় ফিরে যাচ্ছেন শুনে গ্রামবাসীরা যখন মিনতি জানাল: ডাক্তার সাহেব, আপনি বগুড়ায় যাবেন না, পাকসেনারা আপনাকে মেরে ফেলবে...আব্বা বিচলিত হলেন না, ভয় পেলেন না। তাঁর মতো নিরপরাধ বৃদ্ধকে ওরা মারবে না—এই বিশ্বাস বুকে করে মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে গরুর গাড়িতে বগুড়া রওনা হয়ে গেলেন। এর পরের ঘটনা এই। বগুড়ায় পৌঁছাবার আট দিন যেতে না যেতেই জিজ্ঞাসাবাদের এক প্রহসনের পর আধা ঘণ্টার মধ্যেই হানাদার বাহিনীর লোকেরা বগুড়ার ৮ মাইল দক্ষিণে মাঝিড়ার এক বধ্যভূমিতে একটি পুরোনো কবরের মধ্যে ফেলে তাঁকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে। স্থানীয় লোকেরা তাঁদের অতি পরিচিত ডাক্তার সাহেবকে চিনে ঐ পুরোনো কবরেই তাঁকে সমাহিত করলেন।’ (জেব-উন-নেসার রচনা। স্মৃতি ১৯৭১, প্রথম খণ্ড (প্রথম প্রকাশ ১৯৮৮), সম্পাদনা: রশীদ হায়দার)।

কসিরউদ্দিন তালুকদার ডাক্তারি পেশার পাশাপাশি রাজনীতিতেও জড়িত ছিলেন। বিভাগোত্তরকালে মুসলিম লীগের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি বগুড়া লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান, জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান, ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত কলকাতা লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য, বগুড়া মুসলিম লীগের সভাপতি, বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও বগুড়া ডাক্তার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন।
মুসলিম লীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও তিনি ছিলেন বেশ উদার মনের মানুষ। শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি সংগীতের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ অনুরাগ। সব ছেলেমেয়েকেই তিনি নিজ বাড়িতে এক অনুপম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি নিজেও একসময় মঞ্চনাটকে অভিনয় করেন।
ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বগুড়ায় থাকাকালে তাঁর বাড়িতে অনেকবার আতিথ্য গ্রহণ করেন। নেতাজি সুভাষ বসুও তাঁর বগুড়া শহরের বাড়িতে এসেছিলেন।
একাত্তরের ২৩ মার্চ বগুড়া শহরে মিছিল শেষে সাতমাথায় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কসিরউদ্দিন তালুকদার নিজেই অগ্রণী হয়ে বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেন, ‘এ দেশকে স্বাধীন করতেই হবে।’
কসিরউদ্দিন তালুকদার ১৮৯৯ সালে মহিষকুণ্ড গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা নকিবুল্লা তালুকদার। তাঁর স্কুলশিক্ষা বগুড়ায়। পরে কলকাতা স্কটিশচার্চ কলেজে পড়াশোনার পর কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯২৯ সালে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৩০ সাল থেকে তিনি বগুড়া শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি পাঁচ মেয়ে ও দুই ছেলের জনক। একসময়ের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আঞ্জুমান আরা তাঁর মেয়ে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান