ডিজিটাল জগৎ ‘নিয়ন্ত্রণে’ কঠোর সরকার

উপাত্ত সুরক্ষা আইন, বিটিআরসির প্রবিধান এবং ওটিটি নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো অপব্যবহারের আশঙ্কা।

ধরুন, বাজারে আগুন। খেপে গিয়ে আপনি ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম মেসেঞ্জারে দুই ছত্র লিখে পাঠালেন বন্ধুকে। বন্ধুটিও আপনার মতো ভুক্তভোগী। হতাশ হয়ে তিনি আপনার বক্তব্যসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করলেন একটি ব্যঙ্গাত্মক মিম। তাতে সরকারের কারও ছবি যুক্ত করে লেখা, ‘অনাহারে নাহি খেদ, বেশি খেলে বাড়ে মেদ।’ মানুষের জমে থাকা এসব ক্ষোভ নিয়ে কাহিনিকার লিখলেন চিত্রনাট্য। সেটি প্রচারিত হলো অনলাইনভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম ওটিটিতে।

আপনি, আপনার বন্ধু, চিত্রনাট্যকার এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্ম—সবাই ঝুঁকিতে পড়তে পারে। কারণ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তো আছেই, এর সঙ্গে আরও তিনটি আইন, প্রবিধান ও নীতিমালা যুক্ত হতে যাচ্ছে। কোনো না কোনো আইন অথবা প্রবিধানে আপনি মামলার মুখে পড়তে পারেন।

খসড়া এসব আইন ও প্রবিধানে এমন সব বিধান যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে, যাতে বন্ধুর সঙ্গে অনলাইনে আপনার গোপন আলাপ প্রকাশ করতে বাধ্য থাকবে ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনকি বিদেশ থেকে কেউ যদি আপনাকে আইন-প্রবিধানে নিষিদ্ধ কোনো বার্তা পাঠায়, তাহলে আপনাকে শনাক্ত করে দিতে বাধ্য থাকবে প্রতিষ্ঠানগুলো।

প্রস্তাবিত এই আইন, প্রবিধান ও নীতিমালা তিনটি হলো তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের তৈরি উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২ (ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট); বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তৈরি ‘রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস’ এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান ও পরিচালনা নীতিমালা, ২০২১। এই তিন আইন, প্রবিধান ও নীতিমালা অংশীজনদের মতামত নেওয়ার পর চূড়ান্ত করা হবে। অবশ্য খসড়া নিয়ে ইতিমধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

এসব খসড়া বিধিবিধানে দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বা জনশৃঙ্খলা রক্ষার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনষ্টকারী, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য ক্ষতিকারক, দেশীয় সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধবিরোধী কোনো কনটেন্ট বা আধেয় প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সমস্যা হলো, এসব বিষয়ের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

সাম্প্রতিক সময়ে যতগুলো সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে এখনো রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড হচ্ছে, তা কি চলতে দেওয়া উচিত?
মোস্তাফা জব্বার, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই অস্পষ্টতাই মানুষকে হয়রানির মুখে ফেলতে পারে। খসড়া আইন, প্রবিধান ও নীতিমালা কার্যকর হলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন, বাক স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং শিল্প-সংস্কৃতিচর্চার যে অধিকার, তা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমনটা হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রে। সব মিলিয়ে সরকার ডিজিটাল জগৎ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপের দিকেই যাচ্ছে।

মোটা দাগে প্রস্তাবিত আইন ও প্রবিধানে যা বলা আছে তা হলো, ইন্টারনেটভিত্তিক যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে এখন বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে ডেটা সেন্টার বা উপাত্ত ভান্ডার স্থাপন করতে হবে। ডিজিটাল দুনিয়ায় মানুষের প্রকাশ্য বিচরণ এবং হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারসহ ব্যক্তিগত যোগাযোগমাধ্যমে নজর রাখা যাবে। সরকার চাওয়া মাত্রই তথ্য সরবরাহ করতে হবে। আইনে জেল-জরিমানার বিধান থাকছে। সংক্ষুব্ধ হলে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ কম।

এই তিন আইন, প্রবিধান ও নীতিমালা নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো

মোস্তাফা জব্বারের দাবি, সংবিধানের বাইরে কিছু করা হয়নি। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, সাম্প্রতিক সময়ে যতগুলো সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে এখনো রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড হচ্ছে, তা কি চলতে দেওয়া উচিত? মন্ত্রী বলেন, সংবিধানে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা আইনের আওতায়। মানুষ স্বাধীনভাবে রাস্তায় চলাফেরা করতে পারবে, কিন্তু উলঙ্গ হয়ে নয়।

উপাত্ত সুরক্ষা আইন সম্পর্কে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশের তথ্য যেন দেশেই থাকে, সে জন্য আইনটি করা হচ্ছে। মানুষকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনটি করা হয়নি।

অবশ্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রেও সরকারের পক্ষ থেকে মানুষের সুরক্ষার নানা যুক্তি তুলে ধরা হয়েছিল। বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি উপেক্ষা করে আইনটি পাসের পর দেখা গেল, গ্রেপ্তার ও হয়রানির ব্যাপক অভিযোগ উঠছে। পরে ২০২১ সালের ১ মার্চ বিবিসি বাংলাকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, এই আইনে কোনো অপরাধের অভিযোগ এলে পুলিশের তদন্তের আগে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না বা তার বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া যাবে না—এমন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

নীতিমালায় ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ কী, তার কোনো উল্লেখ নেই। নিশ্চিতভাবেই এই শব্দ দুটির অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে।
নুরান চৌধুরী, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির আইনের শিক্ষক

উপাত্ত সুরক্ষা, না নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা

ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট বা উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২–এর খসড়ার দিকে যাঁরা নজর রাখছেন, তাঁদের উদ্বেগের জায়গা মূলত তিনটি । প্রথমত, ফেসবুক, টুইটার, গুগল, আমাজনসহ বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে উপাত্ত জমা রাখার বাধ্যবাধকতা। দ্বিতীয়ত, নির্বাহী বিভাগকে অত্যধিক ক্ষমতা দেওয়া এবং তৃতীয়ত, সরকারি কর্মচারীদের দায়মুক্তি।

এই আইনে ডেটা বা উপাত্ত বলতে বোঝানো হয়েছে কম্পিউটার ব্যবস্থায় থাকা যেকোনো তথ্য, জ্ঞান, ঘটনা, ধারণা বা নির্দেশনা। আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করবেন মহাপরিচালক, নিয়ন্ত্রক, প্রক্রিয়াকারী বা সংগ্রহকারী। এঁরা মূলত সরকারি কর্মকর্তা বা সরকারের নিয়োগ করা লোক।

উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া অনুযায়ী দেশের ভেতর বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যে উপাত্ত ভান্ডার স্থাপন (ডেটা লোকালাইজেশন) করবেন, সেটিতে বাংলাদেশের আদালত ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা কর্তৃপক্ষের প্রবেশাধিকার থাকবে।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার ভেতর উপাত্ত ভান্ডার রাখা নিয়ে শঙ্কার কারণ, ব্যক্তিগত উপাত্ত নিয়ে কর্তৃত্বপরায়ণ দেশগুলো গণতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগায়—এমন অভিযোগ আছে। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ফ্রিডম হাউস ‘ইউজার প্রাইভেসি অর সাইবার সভরেইনটি’ নামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিপুল পরিমাণ উপাত্তের কর্তৃত্ব গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমিয়ে দিতে পারে।

উপাত্ত সুরক্ষা আইনের প্রস্তাবিত খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, সরকার দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে মহাপরিচালককে সময়-সময় প্রয়োজনীয় যেকোনো নির্দেশ দিতে পারবে। এর মাধ্যমে সরকারকে বিপুল ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

কারও ব্যক্তিগত উপাত্ত যদি প্রকাশ হয়ে যায়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সরাসরি আদালতে যেতে পারবেন না। উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে মহাপরিচালকের কাছে অভিযোগ করতে হবে। মহাপরিচালক যদি দেখেন এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে, তাহলে তিনি আইনগত ব্যবস্থা বা মামলা দায়েরের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন। তিনি যদি কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে মনে না করেন, তাহলে সাধারণ মানুষের প্রতিকারের উপায় থাকবে না।

শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের। খসড়ার ৬৬ ধারায় বলা হয়েছে, সরল বিশ্বাসে করা কোনো কাজের কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকলে সরকারের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। অবশ্য প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ প্রথম আলোকে বলেন, এই বিধান তাঁরা সংশোধন করবেন।

বিটিআরসির প্রবিধান

বিটিআরসি খসড়া ‘রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস’ তৈরি করেছে আদালতের নির্দেশে। হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন মো. তানভীর আহমেদ নামের এক ব্যক্তির রিটের পরিপ্রেক্ষিতে।

ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির আইনের শিক্ষক নুরান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যতটুকু বুঝি হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল বিশেষত রাজস্বকেন্দ্রিক। কিন্তু নীতিমালায় নানা বিষয়ের অবতারণা করা হলেও রাজস্বের বিষয়ে কিছু নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, ২০৪১ সালে জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের যে রূপকল্পের কথা বলা হয়, এই নীতিমালা হবে সেই রূপকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক।’

কেন এই শঙ্কা, তার ব্যাখ্যায় নুরান চৌধুরী বলেন, প্রবিধানটি কার্যকর হলে শুধু নেটফ্লিক্স, আমাজন নয়, এমনকি গুগলও বাংলাদেশে তার কার্যক্রম চালাতে আগ্রহ হারাবে। কারণ, নীতিমালায় ‘বিশেষ পরিস্থিতি’তে বিটিআরসি যেকোনো কনটেন্ট প্রত্যাহারের নির্দেশ দিতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বিটিআরসি শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিতে পারবে। এ জন্য বিচার বিভাগের অনুমতিরও প্রয়োজন হবে না। কিন্তু নীতিমালায় ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ কী, তার কোনো উল্লেখ নেই। নিশ্চিতভাবেই এই শব্দ দুটির অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে।

খসড়া প্রবিধানে শুধু ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কথা বলা হলেও আসলে কোনো কিছুকেই বাদ দেওয়া হয়নি। এর আওতায় আনা হয়েছে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান, ভার্চ্যুয়াল জগতে সেবাদানকারী যেকোনো প্রতিষ্ঠান ও বার্তা বিনিময়ে ব্যবহৃত যেকোনো অ্যাপ্লিকেশনকে। এসব মাধ্যমে সবকিছুই নজরদারির আওতায় আসবে।

ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় মানুষ এখন হরদম মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যালের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে। এই মাধ্যমগুলো বার্তা প্রেরক ও প্রাপকের পরিচয় গোপন রাখে। বিটিআরসির খসড়া প্রবিধানে বার্তা প্রেরক ও প্রাপককে শনাক্ত করে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী এম এইচ সুপন সম্প্রতি মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির একটি আলোচনায় বলেন, প্রবিধানমালায় এমন অনেক শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলোর কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশে যে প্রবিধানটির প্রস্তাব করা হয়েছে, তার সঙ্গে ভারতের প্রবিধানের মিল আছে। ভারতের ছয় আদালতে এই প্রবিধান নিয়ে ১৭টি মামলা চলছে। মুম্বাই হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল, যদি দেমোক্লিসের শাণিত তরবারির মতো কোড অব এথিক্স দিয়ে ইন্টারনেট যুগের মানুষকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়, তাহলে মানুষ চিন্তার স্বাধীনতার ক্ষুধায় ভুগবে। তাদের বাক্ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়বে।

উল্লেখ্য, সভাসদ দেমোক্লিসকে তখনকার গ্রিক রাজা দায়োনিসিয়াস এক দিনের জন্য রাজ্যভার দিয়েছিলেন। কিন্তু সিংহাসনের ওপর ঘোড়ার লেজের একটিমাত্র চুল দিয়ে বেঁধে একটি তরবারি ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। যাতে দেমোক্লিস বুঝতে পারেন বিলাসিতার প্রাচুর্য থাকলেও রাজার জীবন কতটা ভয় ও অনিশ্চয়তার।

সেবাদাতারা অস্বস্তিতে, নির্মাতারা উদ্বিগ্ন

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানি ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্ল্যাটফর্ম গ্লোবাল নেটওয়ার্ক ইনিশিয়েটিভ (জিএনআই) প্রস্তাবিত এই প্রবিধান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত ৯ মার্চ এই উদ্বেগের কথা তারা বিটিআরসিকে জানিয়েছে। জিএনআই বলছে, বাক্‌স্বাধীনতার জন্য হুমকি তৈরি করবে এই প্রবিধান। এটির প্রয়োগ হলে পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ ও তথ্য দেওয়ার জন্য অযৌক্তিক চাপ তৈরি হবে।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে যে ওটিটি কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান ও পরিচালনা নীতিমালা, ২০২১–এর খসড়া প্রকাশ করেছে, সেটি নিয়েও উদ্বেগ আছে। যদিও দাবি করা হয়েছে এই নীতিমালার উদ্দেশ্য, সৃজনশীলতা লালন, সৃজনশীল শিল্পকর্মে সহযোগিতা এবং চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাসহ বাক্স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা। কিন্তু বেশ কিছু শব্দের ব্যাখ্যা ও আওতা সম্পর্কে বলা হয়নি।

জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ নির্মাতা আশফাক নিপুণ প্রথম আলোকে বলেন, ওটিটি নীতিমালার কথা বলে যেটা আরোপ করা হচ্ছে, তা পৃথিবীর কোথাও নেই। খসড়ায় অস্পষ্ট কিছু বিষয় রাখা হয়েছে। যেমন অনুভূতিতে আঘাত লাগা। তিনি বলেন, একজন নারী-পুরুষ যদি পাশাপাশি হাঁটে এমন দৃশ্যে কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। যেকোনোভাবেই যে কেউ সংক্ষুব্ধ হতে পারেন। এর জন্য যদি বিচার-আচার হয়, তাহলে তো নির্মাতা বা ওটিটি প্ল্যাটফর্ম কর্তৃপক্ষের দিন যাবে আদালতে দৌড়াতে দৌড়াতে।