সাক্ষাৎকার: ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. টিটো মিঞা
ডেঙ্গু, করোনা, না ইনফ্লুয়েঞ্জা, বুঝবেন কীভাবে
করোনা মহামারির মধ্যে কয়েক মাস ধরে ঢাকায় চলছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। এর মধ্যে ঋতু পরিবর্তনজনিত জ্বর-ঠান্ডায় আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। জ্বর, সর্দি, শরীরে ব্যথাসহ এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন, তাঁর আসলে কী হয়েছে? এ পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মো. টিটো মিঞা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ টিটো মিঞার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. আবদুল্লাহ আল হোসাইন।
এখন তো ডেঙ্গু, কোভিড-১৯ ও মৌসুমি জ্বর হচ্ছে। কারও যদি জ্বর হয়, তাহলে তিনি কীভাবে বুঝবেন যে তাঁর কোন ধরনের জ্বর হয়েছে? পার্থক্যটা কীভাবে করবেন?
ডা. টিটো মিঞা: এখন তিনটিই চলছে একসঙ্গে; যদিও কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। ডেঙ্গুর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো জ্বরের সঙ্গে গা ব্যথা করবে, নাকে পানি আসবে কম। সে হিসাবে গা ও চোখে ব্যথা, সর্দি-কাশি কম হলে আমরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে বলে শুরুতে ধারণা করি। আর সর্দি-কাশি হলে, গায়ে ব্যথা না হলে ইনফ্লুয়েঞ্জা ও কোভিড-১৯-এর কথা চিন্তা করি। প্রাথমিকভাবে এ দুটির উপসর্গ একই। অন্তত মৃদু উপসর্গের হলে এমনটাই ধারণা করা যায়। আর কোভিড গুরুতর হলে তা অক্সিজেন স্যাচুরেশনের মাত্রা কমে যাওয়া দেখে বোঝা যায়। অন্যদিকে, ইনফ্লুয়েঞ্জাতে র্যাশ হয় না বললেই চলে। বাকিটা রক্তের বিভিন্ন উপাদানের মাত্রা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে। এ ছাড়া রোগীর হিস্ট্রি (ইতিহাস), যেমন পরিবারে সম্প্রতি কারও সর্দি হলে কোভিডের কথা ভাবা হয়। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে একই পরিবারের অন্য সদস্যদের গায়ে ব্যথা থাকলে ডেঙ্গু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়। যদি কনফিউজড হই যে আসলে কোনটা হয়েছে, তখন ডায়াবেটিস, কিডনির কার্যকারিতা—এগুলোর পরীক্ষা করতে বলা হয়। তবে সন্দেহ হলে ডেঙ্গু ও কোভিড পরীক্ষা করা উচিত। কারণ, কোভিড হলে নিজের সুরক্ষা নেওয়ার একটা বিষয় থাকে, যেটা সাধারণ সর্দির (কমন কোল্ড) ক্ষেত্রে দরকার নেই।
জ্বর হলে কী করা উচিত, বিশেষ করে এই করোনাভাইরাস মহামারির সময়?
ডা. টিটো মিঞা: পরীক্ষা করতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডেঙ্গুতেও মানুষ সর্দি-কাশি নিয়ে হাসপাতালে আসতে পারে। তবে সে সংখ্যা কম। তাই আমরা শুরুতেই বলতে পারি না যে কোনটা হয়েছে। রোগীর ইতিহাস আমাদের সাহায্য করে, আর পরীক্ষা রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত করে। আবার কোভিডে ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশ ক্ষেত্রে আরটি-পিসিআর পরীক্ষার ফলাফল ‘ফলস নেগেটিভ’ হয়। সে ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির ফলোআপ, সিটি স্ক্যান বুঝতে সাহায্য করে আসলেই কোভিড হয়েছে কি না।
শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের এখন জ্বর হলে ঝুঁকি কতটুকু?
ডা. টিটো মিঞা: ব্যতিক্রম কিছু কেস ছাড়া শিশুদের গুরুতর কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন বেশি। এ ক্ষেত্রে তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়; এমনকি হালকা উপসর্গ হলেও।
এখন জ্বর হলে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে যান। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?
টিটো মিঞা: আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই। এর মুখোমুখি হতে হবে। এখন এসবের চিকিৎসা আছে। দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে তাঁরা একটা সিদ্ধান্তে চলে আসবেন রোগ সম্পর্কে। সব সময় চিকিৎসকের সংস্পর্শে থাকতে হবে।
জ্বর হওয়ায় বর্তমানে প্রাথমিকভাবে খাবারদাবারের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন হওয়ার দরকার আছে? আর কী কী বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত?
টিটো মিঞা: খাবারের সঙ্গে এগুলোর সম্পর্ক নেই। তবে এখন টাইফয়েড ও জন্ডিস দেখা যাচ্ছে, যা পানিবাহিত রোগ এবং খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। এ জন্য জীবাণুমুক্ত পানি পান করতে হবে। ডায়রিয়াসহ জ্বর হলেও তা একটানা ছয় থেকে সাত দিন থাকলে চিন্তা করতে হবে, এটা টাইফয়েড হতে পারে। এমন ক্ষেত্রে মাথাব্যথাসহ জ্বর হলে সর্দি-কাশি থাকে না। জন্ডিস হলে খাবারে রুচি কমে, প্রস্রাব হলুদ হয়।
আপনি তো দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা করছেন। জ্বর নিয়ে কি মানুষের মধ্যে উদাসীনতা লক্ষ করেছেন? আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
টিটো মিঞা: আমাদের বাঙালিদের জ্বর নিয়ে উদাসীনতা আছে। তারা স্বাস্থ্যসচেতন নয়। এটাকে গুরুত্ব দিতে চায় না। তবে এখনকার মৌসুমে, যখন তিনটি (কোভিড ১৯, ডেঙ্গু ও ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বর) একসঙ্গে চলছে, তখন জানা উচিত কোনটা হয়েছে। এটা চিকিৎসকদের যেমন জানা উচিত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও এগুলো বোঝা উচিত। ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বর দুই সময়ে হয়—মার্চ-এপ্রিল ও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। সে জন্য এখন ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরের অনেক রোগী আসছে।
জ্বরের বিষয়ে সচেতনতা আরও বাড়াতে কী করা উচিত বলে মনে করেন?
ডা. টিটো মিঞা: গণমাধ্যম সাহায্য করতে পারে। এ ছাড়া যথাযথ ডিজিজ সার্ভেল্যান্স (রোগ পর্যবেক্ষণ) থাকা উচিত। যেমন ঢাকার কোনো অঞ্চলে জ্বরের প্রকোপ বেশি। সে ক্ষেত্রে সেই বিশেষ এলাকায় জরিপ জরুরি। আর স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সেখানকার মানুষকে গিয়ে সচেতন করবেন। আবার কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় টাইফয়েড ধরা পড়লে পরীক্ষা করে দেখতে হবে সেখানকার পানিতে কোনো সমস্যা আছে কি না। এখানে দুটি বিষয় দরকার—স্বাস্থ্য সচেতনতা ও ডিজিজ সার্ভেল্যান্স, যার মাধ্যমে জানা দরকার রোগের কারণ, কোন এলাকায় কীভাবে হচ্ছে।