ঢাকার জন্মাষ্টমীর মিছিল সেকাল-একাল

শ্রীকৃষ্ণের পবিত্র জন্মতিথি জন্মাষ্টমীর মিছিলের প্রধান অনুষঙ্গ হলো গোকুলবাসী শিশু কৃষ্ণের নানা কর্মকান্ড–লীলা। মিছিলের মূল বিষয়গুলো একই রয়ে গেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে উপস্থাপনায় l ছবি: সাইফুল ইসলাম
শ্রীকৃষ্ণের পবিত্র জন্মতিথি জন্মাষ্টমীর মিছিলের প্রধান অনুষঙ্গ হলো গোকুলবাসী শিশু কৃষ্ণের নানা কর্মকান্ড–লীলা। মিছিলের মূল বিষয়গুলো একই রয়ে গেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে উপস্থাপনায় l ছবি: সাইফুল ইসলাম

জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রায় বরাবরের মতোই কৃষ্ণের সাজে ছিল শিশুরা। ছিলেন মাথায় ঝুড়ির ওপর কৃষ্ণকে বয়ে চলা বাবা বাসুদেব। গদা হাতে কংস রাজা, হাতি, ঘোড়া—সবই ছিল। কিন্তু মোহনের মন পড়ে ছিল সেই সত্তর বছর আগে। মোহন মানে, ইজাজ মোহন। কৃষ্ণভক্ত মা কৃষ্ণের নামগুলোর একটাই বেছে নিয়েছিলেন ছেলের জন্য। একসময়কার প্রকৌশলী ৭৭ বছরের মোহন বললেন, ‘আমার ছেলেবেলার জন্মাষ্টমীর মিছিল ছিল অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত। অনেক সজীব।’

ইতিহাসের বইপত্রগুলো সাক্ষ্য দেয়, ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো সামাজিক উৎসবগুলোর একটি হলো ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথির এই জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা। কৃষ্ণের জন্মোৎসবের এই মিছিল ঢাকায় শুরু হয়েছিল ১৬ শতকের মধ্যভাগে; ঢাকা মোগল রাজধানী হওয়ারও ৫৫ বছর আগে।

মুনতাসীর মামুন ইতিহাসবিদ ভুবনমোহন বসাককে উদ্ধৃত করে বলেছেন, ১৯৫৫ সালে বংশালের এক সাধু প্রথমে শ্রীশ্রীরাধাষ্টমী মিছিলের আয়োজন করেছিলেন। সেই সাধুর উৎসাহেই পরে কৃষ্ণের জন্মতিথিতে মিছিল করার অনুমতি মেলে। ১৫৬৫ সালে জন্মাষ্টমীর নন্দোৎসবের সময় প্রথমবার জাঁকজমকের সঙ্গে মিছিল হয়। ঢাকার মুসলমানেরা এই মিছিলকে বলত ‘বার গোপালের মিছিল’।

চিত্রশিল্পী পরিতোষ সেন তাঁর আত্মজীবনী জিন্দাবাহার-এ বলেছেন, আক্ষরিকভাবে জন্মাষ্টমীর মিছিল ছিল সর্বজনীন। চল্লিশের দশকে তাঁর দেখা জন্মাষ্টমী মিছিল নিয়ে মোহনও বললেন, সে সময় এখনকার চাইতে মিছিলে অনেক বেশি লোক হতো। মিছিলে যোগ দেওয়া আর পথের ধারে দাঁড়িয়ে দেখাদের দলের প্রায় অর্ধেকই ছিল মুসলমান। গোলমরিচের ঝাল নাড়ু আর নারকেলের মিষ্টি নাড়ুর লোভে তাঁর মুসলমান বন্ধুরা ভিড় করতেন মিছিলে। স্মৃতি হাতড়ে আরও বললেন, তাঁর ছেলেবেলায় জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা নেচে-গেয়ে মাতিয়ে রাখতেন হরিজন নারী-পুরুষেরা। বড় নথ আর আলাদা ঢঙে শাড়ি পরা হরিজন নারীদের দেখলেই চেনা যেত। তাঁর কথায়, ‘ওই এক দিনই ওরা হিন্দু ব্রাহ্মণদের সঙ্গে দাঁড়াতে পারত। ব্রজবুলী ভাষায় কীর্তন গাইত ওরা।’

গতকালের মিছিলে হরিজনদের আলাদা করে চোখে পড়েনি; যেমন মাইকের উঁচু গ্রামের শব্দে হারিয়ে গেছে কীর্তনের দলের ‘হরে কৃষ্ণ, হরে রাম’ ধ্বনি। ইতিহাসবিদ যতীন্দ্রমোহনের
লেখায় পাওয়া যায়, ১৭ শতকের মিছিলের সঙ্গে ভক্ত-বৈষ্ণবেরা খোল-করতাল বাজিয়ে কীর্তন গাইতে গাইতে চলতেন। ওই কীর্তন ছিল জন্মাষ্টমীর মিছিলের প্রাণ।

বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি কাজল দেবনাথও বললেন কিছু হারিয়ে যাওয়া রীতির কথা। পঞ্চাশের দাঙ্গার পর ঢাকায় জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। একাত্তরে স্বাধীনতার পর ছোট পরিসরে শুরু হয়। শেষমেশ ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি ও বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের উদ্যোগে কেন্দ্রীয়ভাবে আবার ঢাকার জন্মাষ্টমীর মিছিল চালু হয়। তিনি জানালেন, প্রবীণদের কাছে শুনে পুরোনো আঙ্গিকেই জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা আয়োজনের চেষ্টা ছিল। কিন্তু কিছু পরিবর্তন মেনে নিতে হয়েছে। গাইয়েরা খোল-করতাল বাজিয়ে যে নগর কীর্তন করতেন, তার জায়গায় এসেছে আধুনিক রেকর্ড আর শব্দযন্ত্র। আরেকটা বড় পরিবর্তন এসেছে মিছিলের পথচলায়। আগে মূলত হেঁটেই যেতেন সবাই। এখন ট্রাক-পিকআপ ভ্যান থাকে বাহন হিসেবে। গতকালকের শোভাযাত্রায়ও ট্রাক, পিকআপ ভ্যান আর রিকশা ভ্যানের সংখ্যা ছিল তিন শতাধিক।

জন্মাষ্টমীর মিছিল দেখতে শিশু সাদ এসেছিল বাবা সোবহান মামুনের সঙ্গে। প্রেসক্লাব এলাকার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণের মাথার কাছে সাতফণা উঁচিয়ে ধরা সাপের পরিচয় জানতে চাইছিল বারবার। সোবহান সাহেবের অপ্রস্তুত চেহারা দেখে কাছে দাঁড়ানো শিউলি রানী তাঁর হয়ে জবাবটা দিলেন। মামা কংস রাজার হাত থেকে বাঁচাতে কী করে বাসুদেব নবজাতক কৃষ্ণকে নাগরাজ বাসুকির প্রহরায় যমুনা পার করে গোকুলে রেখে এলেন, সেটা বললেন তিনি। কী করে গোকুলে নন্দ আর দেবকীর সংসারে কৃষ্ণ বড় হতে লাগলেন, সেই গল্পও বাদ পড়ল না। ইতিহাসের বইপত্রে ঘুরেফিরে এসেছে ঢাকার জন্মাষ্টমী মিছিলের সর্বজনীন চেহারার কথা। তার খুব পরিবর্তন বোধ হয় হয়নি।