ঢাকার যানজট শেষ হওয়ার নয়

>
গাড়িতে গিজগিজ করছে সড়ক। রাজধানীতে এমন যানজট নিত্যদিনের চিত্র। ছবিটি গতকাল​ সকালে কাজী নজরুল ​ইসলাম অ্যাভিনিউ থেকে তোলা l প্রথম আলো
গাড়িতে গিজগিজ করছে সড়ক। রাজধানীতে এমন যানজট নিত্যদিনের চিত্র। ছবিটি গতকাল​ সকালে কাজী নজরুল ​ইসলাম অ্যাভিনিউ থেকে তোলা l প্রথম আলো

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস-এর ২৩ সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ঢাকা শহরের যানজটের কারণ ও এর সমাধানের সম্ভাব্য উপায়। প্রতিবেদনে নিজের অভিজ্ঞতাকেও স্থান দিয়েছেন প্রতিবেদক


আমি ঢাকায় ছিলাম। বলতে গেলে, আমি যানজটেই ছিলাম। একে অন্যভাবে বললে আরও ভালো বোঝানো যেতে পারে এভাবে: আমি যানজটে আটকা ছিলাম, তাই আমি ঢাকায় ছিলাম। বাংলাদেশের এই রাজধানী শহরে আপনি যদি কিছুটা সময় ব্যয় করেন, ‘যানজট’ শব্দটিকে নতুনভাবে দেখা শুরু করবেন। সেই সঙ্গে শুরু করবেন কীভাবে একে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে তা-ও।
অন্য শহরগুলোতে দেখবেন, রাস্তার ওপর গাড়ি। আছেন পথচারীও। হয়তো কোনো উপলক্ষে রাস্তা থাকে বন্ধ। তাই সেখান দিয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু ঢাকার অবস্থা ভিন্ন। ঢাকার রাস্তার যানজট, সেটা একেবারে সীমার বাইরে। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এমন ব্যাপক ও স্থায়ী যে, এটা এ শহরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে গেছে। এটাই এ শহরের আবহাওয়া; একটা ঝড়; যা কখনো শেষ হওয়ার নয়।
ঢাকাবাসীর সঙ্গে কথা বললে তাঁরা আপনাকে বলবেন, যানজট যে আসলে কী, তা বিশ্বের বাদবাকি মানুষ বুঝবে না। এটা এমনই যে ভারতের মুম্বাই, মিসরের কায়রো বা যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো শহরের খুব খারাপ যানজট পরিস্থিতিও তুলনামূলকভাবে ঢাকার রাস্তার গাড়িচালকদের কাছে একটা ভালো দিনের মতো মনে হবে।
বিশেষজ্ঞরাও এ ব্যাপারে একমত। বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহর নিয়ে ২০১৬ সালের এক জরিপে বলা হয়েছে, মানুষের জীবনযাত্রার মান নিয়ে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বার্ষিক প্রতিবেদনে ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার স্থান মিলেছে ১৩৭তম। ঢাকা শুধু পেছনে ফেলতে পেরেছে নাইজেরিয়ার বৃহত্তম শহর লাগোস, লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি ও যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ককে। ঢাকার অবকাঠামোকে যেকোনো শহরের চেয়ে খারাপ হিসেবেও তুলে ধরা হয়েছে জরিপে।
গড়ে উঠছে মেগাসিটি: উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্যান্য মেগাসিটির মতো ঢাকাও চলছে দ্রুত নগরায়ণ ও একটা আবদ্ধ শহরের পথে। এ শহরে গড়ে উঠছে রিয়েল এস্টেট বাজার, বাড়ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপস্থিতি। প্রসার ঘটছে জাঁকালো সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনযাত্রার। আর এসবে ঢাকা পড়ছে লাগামহীন দুর্দশার বিষয়: দারিদ্র্য, দূষণ, ব্যাধি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ, উগ্র সহিংসতা ও সন্ত্রাসী হামলা।
যানজট ঢাকাকে একুশ শতকের অকার্যকর নগরায়ণের সেরা উদাহরণে পরিণত করে শিক্ষাবিদ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের কাছে এ শহরের সুনাম নষ্ট করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে ভগ্ন শহর হিসেবেও ঢাকাকে তুলে ধরেছে যানজট। ঢাকাকে এটা পরিণত করেছে এক অদ্ভুত শহরে; যা একই সঙ্গে খ্যাপাটে ও নিশ্চল। বদলে দিয়েছে ১ কোটি ৭৫ লাখের বেশি নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ছন্দকেও।
খুব বেশি আগে নয়, ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র ডেইলি স্টার ‘ফাইভ থিঙ্গস টু ডু হোয়াইল স্টাক ইন ট্রাফিক’ (জ্যামে আটকে যে পাঁচটি কাজ করবেন) শীর্ষক একটি নিবন্ধ ছাপিয়েছে। পরামর্শগুলোর মধ্যে ছিল বন্ধুদের সঙ্গে খোশ আলাপে মেতে ওঠা, বইপড়া ও সাময়িকী বা ডায়েরিতে লেখা ইত্যাদি।
যেন ছড়িয়ে ফেলা দেশলাই বাক্স: আমার ঢাকা সফরের প্রথম অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল গত বছরের মার্চে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণ পাশ দিয়ে নগরের কেন্দ্র অভিমুখে ছুটে চলা মহাসড়কটিতে গাড়িতে চড়ার মধ্য দিয়ে। এ সড়কের অবস্থা নিয়ে জানতে আপনি যদি ওয়েবসাইটে খোঁজাখুঁজি করেন, তবে ফেসবুকের পাতায় এ রকম কোনো শিরোনাম চোখে পড়তে পারে—‘নরকযাত্রার পথে মহাসড়ক, বিমানবন্দর সড়ক’। অনলাইনে ছাড়া আলোকচিত্রগুলোতে এ নরকযাত্রার প্রকৃতি দৃশ্যমান হয়।
ওপর থেকে তোলা ছবিতে দেখা যায়, সড়কের আট লেনজুড়ে বিভিন্ন কৌণিক অবস্থানে সারি বেঁধে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মোটরযান। এ যেন কোনো ক্ষিপ্ত শিশুর ছড়িয়ে ফেলা এক সেট দেশলাই বাক্স। এ সড়কে সকালের যাত্রা, সে তো মহাজাগতিক দুর্বিপাকের মতো।
ছবিগুলো আমাকে ভীষণ খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ার জন্য আগেই প্রস্তুত করে রেখেছিল। যদিও ঢাকায় যাত্রার সময় আমাকে বলা হয়েছিল, নগরের যানজট অস্বাভাবিক রকম কম থাকবে। সে সময় কয়েক সপ্তাহ হরতাল চলছিল। দেশজুড়ে সাধারণ ধর্মঘট ও পরিবহন অবরোধ। নতুন নির্বাচনের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টায় হরতাল ডেকেছিল বিরোধী দল বিএনপি। রাস্তায় বিক্ষোভ ও বিক্ষিপ্ত সহিংসতায় চলা হরতালে রাজধানীর নিত্যদিনের জীবনযাত্রায় ঘটছিল বিঘ্ন। স্থবির হয়ে পড়েছিল নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাপন। আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব ও নিরসন-অযোগ্য ঢাকার সড়কগুলোর দীর্ঘ যানজটকে মিটিয়ে দিয়েছিল হরতাল-অবরোধ।
বুঝতে লাগল কয়েক মিনিট: আমার ঢাকা সফরে বিমানে একজন বাংলাদেশি আমাকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘তোমাকে ঢাকায় হয় ভয়াবহ যানজট, না-হয় সত্যিকারের ভয়াবহ যানজটে পড়তে হবে। তবে হরতালে তা মোটেও থাকবে না। যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক থাকবে।’ ভয়াবহ যানজট, সত্যিকারের ভয়াবহ যানজট, কোনো যানজট না থাকা, যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক থাকা—এগুলো যে কোনো বৈজ্ঞানিক শব্দ (স্বতঃসিদ্ধ বিষয়) নয়, তা বুঝতে ঢাকায় মাত্র কয়েক মিনিট লাগল। যখন আমার বিমানটি বিমানবন্দরে নামল; আমি একটি ট্যাক্সি নিলাম। দুর্দশার মহাসড়কটিতে পৌঁছানোর আগে ট্যাক্সি একটা চক্কর পেরিয়ে বিমানবন্দর ত্যাগ করল।
গাড়ি চলল ২০ সেকেন্ড। তারপরই থেমে পড়ল। নিশ্চল ওই অবস্থায় আমার ট্যাক্সি অলস দাঁড়িয়ে পার করল কয়েক মিনিট। এরপর রহস্যজনক কারণে শুরু করল আবার ধীর গতিতে চলা। এক মিনিট বা তারও কম সময়ের জন্য বাধাহীনভাবে গাড়িগুলো চলতে দেখা গেল খুব কমই। গাড়ি এক-একটা দূরত্ব পার হচ্ছিল সম্ভবত ঘণ্টায় ১৫ মাইল গতিতে। কিন্তু শিগগিরই আমরা আবারও পড়লাম সেই নিশ্চল থেমে থাকার মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রে এক অঙ্গরাজ্য থেকে অন্য অঙ্গরাজ্যের সড়ক ধরে যাওয়ার পথে ‘থামা ও চলার’ যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল, এটা যেন সে রকমই কিছু। সেখানে সড়কে গাড়ির সঙ্গে গাড়ি লেগে থাকলে ও এ নিয়ে রেডিওতে খবর শুনলে হয়তো মনে হতো একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। আকাশে চক্কর দিতে দেখা যেত হেলিকপ্টারকেও। কিন্তু ঢাকার এ ঘটনাটিতে সমস্যা কোনো দুর্ঘটনা নয়। সমস্যা ঢাকা নিজেই।
আড়াই ঘণ্টায় সাড়ে আট মাইল: তখন গরম ছিল। আমিও ভুগছিলাম যাত্রার ক্লান্তিতে। হালকা ঝিমানো শুরু করলাম। ঘণ্টা খানেক পর সংবিৎ ফিরে পেয়ে দেখলাম, যানজট আরও জট পাকিয়েছে। অবস্থা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। একসময় নগরের কেন্দ্রে পৌঁছালাম। কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ের প্রশস্ত সড়কটিতেও আটকে গেলাম পথচারী ও শত শত গাড়ির ভিড়ে। জায়গা করে নিতে সেখানেও প্রতিযোগিতা। সড়কে ছিল যাত্রীবাহী গাড়ি, ছিল তিন চাকার অটোরিকশা। বাসগুলো এতটাই লোকে ঠাসা ছিল যে, অনেক যাত্রী দরজা দিয়ে ঠেলে বেরিয়ে পড়ছিলেন। কেউ কেউ ছিলেন দরজা আগলে।
আমার ট্যাক্সি একটি চক্কর পেরিয়ে বাঁয়ে পান্থপথ-তেজগাঁও লিংক রোডে প্রবেশ করল। খানিকটা পথ গিয়ে ট্যাক্সিচালক উল্টো মোড় নিলেন। নির্ধারিত হোটেলে পৌঁছে দিতে তিনি কৌশল খাটিয়ে একটি গলিপথে ঢুকে পড়লেন। পথটি ফাঁকাই ছিল। দীর্ঘ যাত্রাপথের শেষ ১০০ গজের রাস্তাটুকুতে এই প্রথম যানজট-কোলাহলমুক্ত দৃশ্যের দেখা পেলাম।
বিমানবন্দর থেকে হোটেল পর্যন্ত স্থানের দূরত্ব সাড়ে আট মাইল। এ পথ পেরোতেই আমাদের লাগল পাক্কা আড়াই ঘণ্টা। হোটেলের প্রবেশপথে আমরা এগিয়ে গেলাম। ট্যাক্সি ঘুরিয়ে যাওয়ার সময় চালক বিদায় সম্বোধনে বললেন, ‘সামান্য যানজট।’ আমিও বললাম, ‘তেমন মন্দ নয়।’
২০০০ সালে সাংবাদিক উইলিয়াম ল্যাঞ্জভিশে লিখেছিলেন, বাংলাদেশ এমন কোনো দেশ নয়, যতটা না দুর্দশাগ্রস্ত। এটা অতিরঞ্জিত কথার মতো শোনালেও যানজটে অচল ঢাকার সড়কগুলো বা সেখানে যে নিশ্চলতা, সেটা এই দুর্দশাকেই প্রমাণ করে।
কেন যানজট: মূল কথা হলো, যানজট আসলে ঘনত্বের ব্যাপার। যখন বহু মানুষ একসঙ্গে ছোট একটি জায়গায় ঢুকতে চায়, তখন এই জটের সৃষ্টি হয়। জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর ১২তম দেশ। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষ নিয়ে বাংলাদেশ এই তালিকার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ও দরিদ্র দেশ। ব্যাপারটা একটু ভিন্নভাবে বলি: বাংলাদেশের আয়তন রাশিয়ার আয়তনের ১১৮ ভাগ, কিন্তু রাশিয়ার চেয়ে এর জনসংখ্যা আড়াই কোটি বেশি। বাংলাদেশের এই জনসংখ্যার ঘনত্ব সমস্যা ঢাকায় আরও ঘনীভূত হয়েছে। বাস্তবিক পক্ষে, ঢাকাই বাংলাদেশ—এটাই এই সমস্যার একটা কারণ। দেশের সরকারি কার্যক্রম, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চাকরির সিংহভাগ ঢাকায় কেন্দ্রীভূত। প্রতিবছর প্রায় চার লাখ মানুষ ঢাকায় আসছে। এই বিপুল অভিবাসনের কারণে ঢাকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ মেগাসিটি, সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল শহরগুলোর একটি।
যে শহরে এক কোটির বেশি মানুষ বসবাস করে, সেখানে মৌলিক অবকাঠামো নেই বললেই চলে। সঙ্গে রয়েছে আইনের শাসনের অভাব। অথচ একটি শহর বসবাসযোগ্য হতে হলে এগুলো প্রয়োজন। ঢাকায় ট্রাফিক বাতির সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। যদিও এগুলো কমবেশি আলংকারিক। খুব কম চালকই এই বাতির সংকেত মেনে চলেন। ঢাকার নৈরাজ্যকর রাস্তার প্রধান সমস্যাই হচ্ছে এখানে রাস্তার পরিমাণ কম। ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকায় রাস্তার পরিমাণ শহরের মোট আয়তনের মাত্র ৭ ভাগ (প্যারিস ও বার্সেলোনার মতো ১৯ শতকের শহরে সড়কের পরিমাণ ৩০ ভাগ)। ফুটপাতও একটা সমস্যা। ঢাকায় হাঁটার রাস্তা খুব কম। যাও আছে তাও হাঁটার অযোগ্য, হকার ও গরিব মানুষের দখলে।
পথ দেখাতে পারে পাতালপথ: আসলে ঢাকার মতো শহরের ভিড়ভাট্টা দূর করার পথ হচ্ছে, পথচারীদের রাস্তার নিচ দিয়ে চলাচল করানো, রাস্তার ওপর দিয়ে নয়। কিন্তু ঢাকায় কোনো পাতালপথ নেই। এমনকি সে রকম কিছু বানানোর পরিকল্পনাও সরকারের নেই। আর ব্যক্তিগত গাড়ি ক্রমবর্ধমান হারে মর্যাদার প্রতীকে পরিণত হওয়ায় সমস্যা আরও বেড়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ি মধ্যবিত্তের কাছে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে প্রতিবছরই ঢাকার রাস্তায় হাজার হাজার ব্যক্তিগত গাড়ি নামছে।
যানজট মানুষকে বানাচ্ছে অসামাজিক: খোদ বাংলাদেশ সরকারের হিসাবমতে, ঢাকার যানজট প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা খেয়ে ফেলছে। ফলে শহরের অর্থনীতি থেকে প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার নষ্ট হচ্ছে। আবার মানুষের জীবনযাত্রার ওপরও এই যানজটের অন্য রকম প্রভাব রয়েছে। বুয়েটের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক সারওয়ার জাহান বলেন, ‘ঢাকা শহর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে গেছে। এই যানজটের কারণে মানুষ সামাজিকতা করতে পারে না। আপনি হয়তো মাঝেমধ্যে বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যেতে চাইবেন, কিন্তু এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে অনেক সময় লেগে যায়।’
অন্য কথায়, ঢাকার যানবাহনব্যবস্থাকে অসুবিধাজনক বা ‘সংকটগ্রস্ত’ বললেও কম বলা হয়। ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকার স্থাপত্য ও পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আদনান মোরশেদ ঢাকার এই ভিড়ভাট্টাকে ‘বড় ধরনের নাগরিক রোগ’ বলে অভিহিত করেছেন, যেটা সময় ‘নষ্ট করেই যাচ্ছে’। ঢাকার বলিষ্ঠ টেক্সটাইল শিল্প দেশটির অর্থনীতিকে গতি দিয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলছেন, ঢাকার যানবাহন ও অবকাঠামোগত সমস্যা সমাধান করা না গেলে এই সফলতা ফিকে হয়ে যেতে পারে। অগ্রগতি থমকে যেতে পারে। যানজটে স্থবির রাস্তা হচ্ছে ঢাকার দুর্দশার অমোচনীয় চিত্র। এটাই হয়তো ঢাকার দুর্দশার সবচেয়ে বড় কারণ।
রিকশা যেন চলমান জাদুঘর: ঢাকার যানবাহনের এই কঠিন পরিস্থিতির মাঝে শুধু রিকশাকেই একটু ভদ্রস্থ যান হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ঢাকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও সর্বব্যাপী যান হলো এই রিকশা। কেউই জানে না, ঢাকায় কত রিকশা রয়েছে (এর মধ্যে খুব সামান্য অংশই আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত)। অনেকের ধারণা, রিকশার সংখ্যা দুই লাখের মতো হতে পারে। কারও কারও মতে, তা আরও কয়েক গুণ বেশি।
ঢাকার রিকশাগুলো দেখতে দারুণ-এ বিষয়ে সবাই একমত হবেন। রিকশাগুলোকে বলা হয়েছে ‘চলমান জাদুঘর’। চোখধাঁধানো রং, রাঙতা আর পর্দা দিয়ে এগুলো সাজানো হয়। আর এর কাঠামোতে থাকে ফুল, চলচ্চিত্র তারকা, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা, পল্লিশোভা ও নগরের বর্ণিল ছবি। রিকশায় আঁকা শহরের ছবি নজর করে দেখলে আপনি একটা মজার বিষয় পাবেন। ব্যতিক্রমহীনভাবে সেখানে থাকবে স্বপ্নিল, শান্ত এক নগর। সে শহরে দেখা যায় পাখির ওড়াউড়ি আর সুউচ্চ অট্টালিকার পেছনে সূর্য অস্ত যায়। শহরের সড়কগুলো পরিষ্কার, শান্ত আর যানজটহীন।
অন্তত অদূর ভবিষ্যতের জন্য বলা যায়, আপনি রিকশায় আঁকা এই ছবিগুলোতেই শুধু ঢাকার সাজানো-গোছানো রূপটি দেখতে পাবেন।
সমাধানের উপায়: শহরের এই দুর্দশার সমাধান কী হতে পারে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সবাই কমবেশি একই কথা বলেন। তাঁরা ট্রাফিক বাতি, রিকশার জন্য আলাদা লেন, গুরুত্বপূর্ণ শাখা সড়ক ও হালকা ট্রেনের কথা বলেন। তাঁরা বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেন। বলেন চট্টগ্রাম ও খুলনার মতো নগরকে দ্বিতীয় প্রধান শহর হিসেবে গড়ে তুলে ঢাকার ওপর চাপ কমানোর কথা। সরকার তার দিক থেকে বলছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কথা। ২০১৫ সালের আগস্ট মাস থেকে এর কাজ শুরু হয়েছে। ১২ মাইলের এ সড়কের নির্মাণে খরচ হবে ১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ঢাকায় এ ধরনের প্রকল্প নিয়ে গভীর সংশয় থাকে। এখানে প্রায়শই প্রকল্পের অগ্রগতি সরকারের অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে বাধাগ্রস্ত হয়।
এই যানজটই যখন ‘প্রিয়’: ঢাকায় থাকা অবস্থায় আমি যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি তাঁদের প্রায় সবার কাছে যানজট একটা আতঙ্ক, ধৈর্য ও সাহসের পরীক্ষা। তবে একই সঙ্গে অন্য ধরনের গর্ব করার মতো বিষয়ও। সারা জীবন ঢাকায় থাকা এক নারী বলেন, বিদেশে অবস্থানের সময় ঢাকার যানজট তিনি ‘মিস করতেন’। ইউরোপ-আমেরিকার বড় শহরগুলোতে তুলনামূলকভাবে যানজট কম থাকায় তিনি খুব অধীর হতেন। ঢাকায় যদি আপনি যানজট ঠেলে কোনোভাবে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারেন, তাহলে ধরে নিতে পারেন আপনি বড় ধরনের জয় পেয়েছেন। ঢাকার যানজট আপনার মনকে চিন্তার একটি খোরাক দেবে। এ শহরে এসে আপনি শেখেন, চলাফেরা করা একটি অসম্ভব কষ্টকর বিষয়। কিন্তু তা একই সঙ্গে ভ্রমণের আদিম আনন্দের কথাও মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় এ সত্যকেও যে যাত্রা শেষ করে গন্তব্যে পৌঁছানো হচ্ছে পরিসরকে জয় করা সময়কে বশ করা।
ঢাকায় অনেক দিন থেকে আমি এখানে চলাফেরার আসল নিয়ম শিখে গিয়েছিলাম। সেটা হলো যতটা সম্ভব বেশি সময় হাতে রেখে রওনা দেওয়া।একপর্যায়ে আমার নিউইয়র্ক ফেরার সময় হলো। ফ্লাইটের বোর্ডিংয়ের সময়ের পাঁচ ঘণ্টা আগেই বিমানবন্দরের দিকে রওনা দিলাম। ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ট্যাক্সিতে উঠলাম। চালক আশ্বাস দিয়ে বলল, এত সকালে রাস্তায় বেশি যানজট থাকবে না।
আমার ভাগ্য ভালো ছিল বলতে হবে। চালকের কথাই সত্যি হলো। তখনো সূর্য ওঠেনি। মধ্য ঢাকার কালো সড়কগুলো দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলছিল। সড়কগুলোতে যানজট ছিল না বললেই চলে। আমরা একসময় বিমানবন্দরের কাছাকাছি চলে এলাম। তখন গাড়ির গতি আরও বাড়ল। আমি জানালার কাচটা নামিয়ে দিলাম। ট্যাক্সিটা প্রতি ঘণ্টায় ৫০ মাইল গতিতে ছুটছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমরা উড়ছি। আর ঠিক তখন।গন্তব্য থেকে মাত্র মাইলখানেক দূরে ছিলাম। তখনই গাড়ি, ট্রাক আর সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভিড় হঠাৎ আমাদের পথ আটকে দাঁড়াল। অবশেষে আমাদের ট্যাক্সির গতি কমল। আমরা আবার ঢাকা শহরের যানজটে ফিরে এলাম। আমরা থামলাম, একটু চললাম আবার থামলাম। আমি এই ভিড়ের কারণটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, এর জন্য আমার ফ্লাইট ধরতে অসুবিধা হবে না। কাজেই আর উদ্বেগ হচ্ছিল না। একপর্যায়ে আমাদের ট্যাক্সির গতির মিটারের কাঁটা ঘণ্টায় প্রায় পাঁচ মাইলে এসে ঠেকল।হঠাৎ আমার মাথায় একটা ভাবনা ভর করল, ঢাকা যে আমাকে প্রভাবিত করেছে তারই প্রমাণ সেটা: এটাকে কি যানজট মনে হয়? কী যে বলেন! এটা কোনো যানজটই না!
(ঈষৎ সংক্ষেপিত)