ঢাকায় আপনাকে দেখে নেব: রাষ্ট্রদূতকে বজলুল হুদা

সাবেক রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের, তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি বজলুল হুদাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল
ছবি: প্রথম আলো

থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদেরের ‘বিশেষ মিশন’ শেষ হচ্ছে। প্রায় দুই বছরের প্রতীক্ষা শেষে এল ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বরের সকাল। একই গাড়িবহরের সঙ্গী হলেও তখন পর্যন্ত ‘বিশেষ মিশনের’ মূল চরিত্রের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। কারাগার থেকে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দীকে’ নিয়ে গাড়িবহরটি ব্যাংককের ডন মং বিমানঘাঁটিতে পৌঁছানোর পর মেজর (অব.) বজলুল হুদাকে তিনি প্রথমবারের মতো দেখলেন। সেটাই তাঁদের প্রথম ও শেষ দেখা। সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সিআইডির কর্মকর্তা আবদুল কাহহার আকন্দের কাছে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ও পালিয়ে থাকা ওই খুনিকে তুলে দিলেন আকরামুল কাদের।

থাই কমান্ডোদের প্রিজনভ্যান থেকে নামিয়ে বজলুল হুদাকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এএন-৩২ উড়োজাহাজে ওঠানো হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিকে ফিরিয়ে আনতে ঢাকা থেকে বিমানবাহিনীর ওই উড়োজাহাজ গিয়েছিল থাইল্যান্ডে। বজলুল হুদা রাশিয়ার তৈরি উড়োজাহাজে ওঠার সময় ঘাড় ফিরিয়ে আকরামুল কাদেরের দিকে তাকালেন। চোখে-মুখে একরাশ ক্ষোভ নিয়ে বেশ শব্দ করেই বজলুল হুদা বললেন, ‘অ্যাম্বাসেডর, ঢাকায় আপনাকে দেখে নেব।’ নির্লিপ্তভাবে আকরামুল কাদের পাল্টা জবাবে বললেন, ‘কোনো সমস্যা নেই। ঢাকায় আমাদের দেখা হবে।’

প্রায় ২৩ বছর পর ‘বিশেষ মিশন’ সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সাবেক ওই কূটনীতিক থাই বিমানঘাঁটির সেদিনের সকালের কথা বারবার বললেন। মৃত্যু অবধারিত জেনেও বজলুল হুদার দম্ভোক্তি আর তিনি যেন ঠিকঠাক ঢাকা যেতে পারেন, সেটাই ছিল তাঁর একমাত্র চিন্তা। দুই যুগ আগের ওই চ্যালেঞ্জিং মিশন সফলভাবে শেষ করার জন্য গর্বিত এই কূটনীতিক কৃতজ্ঞচিত্তে কয়েকজন সহকর্মী ও বন্ধুর কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। ব্যাংকক মিশনে তখনকার সহকর্মী হানিফ ইকবাল, থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রসচিব এবং এক রাজনীতিবিদের বিশেষ সহায়তা ছাড়া এমন একটি কাজ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। তাঁদের সহযোগিতায় অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে এবং কৌশলে কাজ করেছিলেন বলেই বজলুল হুদাকে দেশে ফেরানো গিয়েছিল বলে মনে করেন আকরামুল কাদের।

বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ও পালিয়ে থাকা খুনিদের একজনকে ফেরানোর বিষয়ে ২৫ বছর আগের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আকরামুল কাদের এই প্রথম মুখ খুললেন। গত সপ্তাহে প্রথম আলোর সঙ্গে তাঁর মিরপুর ডিওএইচএসের বাসায় কয়েক ঘণ্টার আলাপচারিতায় ব্যাংকক মিশনের পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকায় হাইকমিশনার থাকার সময় জিম্বাবুয়েতে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবদুল আজিজ পাশা এবং যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনের সময় সে দেশে আশ্রয় নেওয়া এ এম রাশেদ চৌধুরীকে ফেরাতে কাজ করার প্রসঙ্গও এসেছে। অবশ্য আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আর আকরামুল কাদের যুক্তরাষ্ট্রে দায়িত্ব পালনের সময় রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি বজলুল হুদা, আদালতের রায়ে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়
ছবি: সংগৃহীত

নিয়তির পরিণতি

বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার বিবরণ অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরাসরি গুলি করে হত্যা করেন মেজর নূর চৌধুরী ও মেজর বজলুল হুদা। মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯৭৬ সালের ৮ জুন বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত অপর খুনিদের মতো বজলুল হুদাকেও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে নিয়োগ দেন। শুরুতে বজলুল হুদাকে ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে তিনি বাংলাদেশের জাকার্তা ও কুয়েত সিটির মিশনেও কাজ করেছেন। পাকিস্তানে কর্মরত অবস্থায় বজলুল হুদার বিরুদ্ধে মিশনের কর্মচারীদের মারধরের অভিযোগ ছিল।
লিবিয়ার প্রয়াত নেতা মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গবন্ধুর অন্যতম দুই খুনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশিদ ও কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৮৭ সালের ৩ আগস্ট ফ্রিডম পার্টি নামের একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফ্রিডম পার্টির হয়ে মেহেরপুর-২ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন বজলুল হুদা। ১৯৯১ সালে এক জনসভায় বজলুল হুদা প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবকে আমি নিজের হাতে গুলি করে হত্যা করেছি। কার সাধ্য আছে আমার বিচার করার? এ দেশে শেখ মুজিব হত্যার বিচার কোনো দিনই হবে না।’
অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! ঢাকার দায়রা জজ আদালত ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছিলেন। পরে ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট বজলুল হুদাসহ তাঁদের ১২ জনের ফাঁসি নিশ্চিত করে রায় দেন। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি তাঁর ফাঁসি কার্যকর হয়।

মুক্তিযুদ্ধে দুই ভাইকে হারানো আকরামুল কাদের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর খুনিকে ফেরাতে যা যা করা দরকার, তা-ই করেছিলেন। কোনো পিছুটান আটকায়নি তাঁকে
ছবি: প্রথম আলো

‘টু ম্যান’ মিশন

আকরামুল কাদের ১৯৯৬ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ব্যাংককে পৌঁছানোর পরপরই বজলুল হুদার বিষয়ে কনস্যুলার উইংয়ের কর্মকর্তা হানিফ ইকবালের কাছ থেকে ব্রিফিং নিতে শুরু করলেন। হানিফ ইকবাল রাষ্ট্রদূতকে জানালেন, ব্যাংককের একটি সুপার স্টোরে চুরির অভিযোগে পাঁচ মাস আগে, অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের ১২ জুলাই বজলুল হুদা আটক হন। আটকের পর বজলুল হুদা নিজেকে শরণার্থী দাবি করে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) কাছে আবেদন করে জামিনের চেষ্টা করছেন। তবে তাঁকে গ্রেপ্তারের পরপরই থাই কর্তৃপক্ষ বজলুল হুদার পাসপোর্টটি দূতাবাসে পাঠালে কনস্যুলার উইংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে হানিফ ইকবাল তা জব্দ করে ঢাকায় যোগাযোগ করেন। এরপর ঢাকা থেকে তখন নির্দেশ পেয়ে ওই পাসপোর্ট আর ফেরত দেননি।

আকরামুল কাদের দূতাবাসে প্রেষণে নিয়োগপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিলেন, যেভাবেই হোক বজলুল হুদার জামিন আটকে দিতে হবে। প্রতিদিন সার্বক্ষণিকভাবে খোঁজ রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুর ওই খুনির দিকে। নানা অপরাধে ব্যাংককে আটক বাংলাদেশের লোকজনকে ফেরানোর বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে তখন হানিফ ইকবালের সঙ্গে থাইল্যান্ডের কারা কর্তৃপক্ষের একটা ভালো যোগাযোগ তৈরি হয়ে গেছে। এ সম্পর্কের সদ্ব্যবহার করলেন তিনি। পাশাপাশি বজলুল হুদার সঙ্গে ওই কারাগারে আটক বাংলাদেশিদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন হানিফ ইকবাল। সব মিলিয়ে বজলুল হুদার ওপর নজরদারিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব হানিফ ইকবালকে দেওয়া হলো। আর কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পর্যায়ের যোগাযোগের দায়িত্বটা রাষ্ট্রদূত নিজের কাছে রাখলেন।

আকরামুল কাদের বলেন, বজলুল হুদাকে ফেরাতে দুই বছরে কাজ করেছে ‘টু ম্যান মিশন’। তিনি আর হানিফ ইকবাল। ব্যাংকক মিশনের অন্যরা কেউ জানতেন না কোথায়, কখন কী হচ্ছে। এমনকি যেদিন বজলুল হুদাকে ঢাকায় পাঠানো হবে, সেদিনও মিশনের অন্যরা তিনি ঢাকায় পৌঁছানোর পর খবরটি জেনেছিলেন।

কাজটি এতটাই গোপনীয়তার সঙ্গে করা হচ্ছিল, সেটা বলতে গিয়ে তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের ব্যাংকক সফরের প্রসঙ্গ টানেন আকরামুল কাদের। থাইল্যান্ড সফরে গিয়ে দিনের প্রথম ভাগে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুরিন পিতসুয়ানের সঙ্গে আব্দুস সামাদ আজাদের বৈঠক হচ্ছে। একপর্যায়ে বৈঠকের মাঝখান থেকে চলে যান আকরামুল কাদের। রাতে নৈশভোজে হাজির হতেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর রাষ্ট্রদূতকে জিজ্ঞেস করলেন, আলোচনার মাঝপথে এভাবে কোথায় চলে গেলেন? বিনয়ের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত জানালেন, বাসায় গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছিল। নিরুপায় হয়ে তিনি যেতে বাধ্য হন। কিন্তু আসল ঘটনা ছিল থাই সরকারের জ্যেষ্ঠ একজন কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর জরুরি বৈঠক হয় বজলুল হুদাকে নিয়ে।

বজলুল হুদাকে বাংলাদেশে ফেরত আনার ক্ষেত্রে যাঁরা সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন থাইল্যান্ডের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুরিন পিতসুয়ান
ছবি: সংগৃহীত

নেপথ্যের প্রধান চারজন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনিদের প্রথম জনকে ফেরানোর ক্ষেত্রে থাইল্যান্ডে মূল ভূমিকা ছিল চারজনের। বাংলাদেশ দূতাবাসের কনস্যুলার কর্মকর্তা হানিফ ইকবাল, থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুরিন পিতসুয়ান, উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী পিতাক দেবানন্দ এবং এক থাই কূটনীতিক (নামটি ঊহ্য রাখা হলো), যিনি পরে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। তাঁদের চারজনের বিশেষ ভূমিকা ছাড়া কাজটি রীতিমতো অসাধ্য ছিল।

ব্যাংককে দায়িত্ব নিয়ে যাওয়ার পর থেকে চিঠিপত্র চালাচালি, দেখা-সাক্ষাৎ এবং পরে নানা রকম নথিপত্র দিয়ে আকরামুল কাদের সুরিন পিতসুয়ান, পিতাক দেবানন্দ এবং এক থাই কূটনীতিককে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন বজলুল হুদার অপকর্মটি কতটা ভয়াবহ এবং তাঁকে ফেরত নেওয়া বাংলাদেশের জন্য জরুরি। তাঁদের তিনজনই রাষ্ট্রদূতের কথার সঙ্গে প্রয়োজনীয় নথিপত্র মিলিয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে, বজলুল হুদা যাতে মুক্তি না পান, তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাঁকে বাংলাদেশে ফেরতের মামলা শুরু, দ্রুত বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি সই, সবশেষে থাইল্যান্ডের রাজার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনটি দেরিতে পৌঁছানোসহ সব বিষয়ে বিশেষভাবে সহায়ক ছিলেন।

আকরামুল কাদের বলেন, ‘বাংলাদেশে তাঁকে ফেরতের বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার পর বজলুল হুদা থাইল্যান্ডের রাজার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করলেন। এতে আমি বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। পরদিনই সুরিন পিতসুয়ান, পিতাক দেবানন্দ এবং এক থাই কূটনীতিককে বিশেষভাবে অনুরোধ করলাম, যেভাবেই হোক ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন রাজার কাছে দেরিতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করুন। তা না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাঁদের তিনজনই আমাকে আশ্বস্ত করলেন দুশ্চিন্তার কারণ নেই। বজলুল হুদা ঢাকায় পৌঁছানোর আগে ওই চিঠি রাজার কাছে যাবে না।’

বজলুল হুদাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালের ৯ জুলাই থাইল্যান্ডের সঙ্গে বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি সই করে। চুক্তি সইয়ের পরপরই বাংলাদেশ তা অনুসমর্থন করে। কিন্তু সময় গড়িয়ে গেলেও থাইল্যান্ডের পার্লামেন্টে তখনো তা অনুসমর্থন হয়নি। আকরামুল কাদের আবারও থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ওই তিন ব্যক্তির শরণাপন্ন হলেন। তাঁদের তিনজনই রাষ্ট্রদূতকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিলেন। তাঁরা এই বলেও আশ্বস্ত করলেন, বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তিটি থাইল্যান্ডের পার্লামেন্টে অনুসমর্থন না হলেও বজলুল হুদাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে কোনো সমস্যা হবে না। প্রয়োজনে থাইল্যান্ডের মন্ত্রিসভার বিশেষ অনুমোদন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ওই খুনিকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়া হবে। শেষ পর্যন্ত থাই মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়েই কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল।

২৩ বছর আগের ঘটনাপ্রবাহের উল্লেখ করে আকরামুল কাদের বলেন, ‘ব্যাংকক যাওয়ার আগে থাইল্যান্ডের ওই তিনজনের সঙ্গে আমার পরিচয় বা যোগাযোগ কিছুই ছিল না। রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করতে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে আমার চেনাজানা। প্রথম দিন থেকে মনখুলে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি, সহায়তা চেয়েছি। আর নিয়মিতভাবে লেগে থেকেছি, যাতে বজলুল হুদাকে ফিরিয়ে আনা যায়। সব মিলিয়ে পুরো পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমার দৃঢ়চেতা মনোভাব দেখে তাঁরা অকাতরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের ওই সাহায্য কখনো কখনো নিজেদের সীমার বাইরেও ছিল। তারপরও তাঁরা আমাকে সহায়তা করেছিলেন। তা না হলে কাজটি সম্ভব ছিল না।’

নিয়মিত যোগাযোগে চারজন

আকরামুল কাদের বিশেষ ওই মিশনের সাফল্যের পেছনে তখনকার পররাষ্ট্রসচিব মোস্তাফিজুর রহমানের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করেন। প্রতিনিয়ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, আদালতের পর্যবেক্ষণ, ঐতিহাসিক দলিল, যখন যা প্রয়োজন দ্রুত তা ব্যাংককে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন মোস্তাফিজুর রহমান। এ ছাড়া আকরামুল কাদের এ বিষয়ে যেকোনো উদ্যোগ নিলে তার প্রতি একধরনের অকুণ্ঠ সমর্থন থাকত পররাষ্ট্রসচিবের। সব মিলিয়ে এটি আকরামুল কাদেরকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করতে সহায়তা করেছিল।

আকরামুল কাদের বলেন, পুরো প্রক্রিয়ায় পররাষ্ট্রসচিব মোস্তাফিজুর রহমান ছাড়া স্বরাষ্ট্রসচিব সফিউর রহমান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল আহসান চৌধুরীর সঙ্গে এ বিষয়ে নিয়মিত সরাসরি যোগাযোগ হতো। এ ছাড়া কোনো সফর বা অন্য দেশ সফরে ব্যাংককে ট্রানজিটের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদকে ব্রিফ করা হতো।

আকরামুল কাদের জানান, বজলুল হুদাকে দেশে ফেরত পাঠানোর আগে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তখনকার আইনজীবী আনিসুল হক ও সিআইডি কর্মকর্তা আবদুল কাহহার আকন্দকে নিয়ে ব্যাংকক সফর করেন। কয়েক দিনের ওই সফরের সময় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে তাঁরা বেশ কিছু বৈঠক করেন। আর ওই সফর হয়েছিল বজলুল হুদার মামলাটি যখন থাইল্যান্ডের আদালতে চলমান ছিল।

থাইল্যান্ডের এই কারাগার থেকে বের করে আনা হয়েছিল বজলুল হুদাকে
ছবি: রয়টার্স

যেন হলিউডের ছবি

বজলুল হুদাকে বাংলাদেশে হস্তান্তরের মামলাটি শেষ হয়ে গেল। এবার তাঁকে বাংলাদেশে পাঠানোর পালা। রায়ের কয়েক দিনের মাথায় তাঁকে বাংলাদেশে পাঠানোর দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বজলুল হুদাকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি উড়োজাহাজে করে ফেরত আনার সিদ্ধান্ত হলো। ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এএন-৩২ উড়োজাহাজ প্রশিক্ষণের জন্য ব্যাংকক যাবে উল্লেখ করে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের কাছে অনুমতি নেওয়া হলো। পরে দিনটি দুই দিন পিছিয়ে দেওয়া হয়।

আকরামুল কাদের ৮ নভেম্বর খুব ভোরে বিছানা ছাড়লেন। রোজকার তুলনায় এত সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছেন জানতে চাইলেন তাঁর স্ত্রী। উত্তরে শুধু জানালেন, জরুরি ভিত্তিতে সকালেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে। বাসা থেকে সকালেই পৌঁছে গেলেন ব্যাংককের বাং কোয়াং/ক্লং প্রেম কেন্দ্রীয় কারাগারে। কারা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কাগজপত্র সই করার পর বিশেষ গাড়িবহরে তোলা হচ্ছে বজলুল হুদাকে। রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদেরের মার্সিডিজটিও যুক্ত হলো ‘গুরুত্বপূর্ণ বন্দীর’ ওই বহরে। সব মিলিয়ে ছিল ছয়টি গাড়ি। থাইল্যান্ডের স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডোদের একটি ভ্যানে বজলুল হুদাকে তোলা হলো। ওই ভ্যানের সামনে ও পেছনের ভ্যান দুটিতে ছিল ভারী অস্ত্র।

আকরামুল কাদের বলেন, ‘সেদিন সবকিছু দেখে মনে হয়েছিল এটা যেন হলিউডির কোনো ছবি। আর সেই ছবিতে আমিও একটি চরিত্র। বঙ্গবন্ধুর কুখ্যাত খুনিকে এমন গুরুত্ব দিয়ে সব আয়োজন! আর গাড়িবহরের যাত্রা শুরু হলে খেয়াল করলাম আশপাশের যান চলাচল বন্ধ করে বুলেটের গতিতে গাড়িগুলো ছুটছে ডন মং বিমানঘাঁটির উদ্দেশে। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা পৌঁছে গেলাম বিমানঘাঁটিতে অপেক্ষমাণ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এএন-১৩২ উড়োজাহাজের দিকে। সেখানে বজলুল হুদার জন্য অপেক্ষা করছিল আবদুল কাহহার আকন্দ ও তাঁর সহকর্মীরা।’

ঘণ্টা দুয়েকের আলাপচারিতা শেষ হয়ে এলো। গোধূলি ঘনিয়ে আসছে। ২৩ বছর আগের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতি নিজের আর পরিবারের দায়িত্বের কথাও সাবেক ওই রাষ্ট্রদূত জানালেন। আকরামুল কাদের বলেন, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মা পাঁচ ছেলেকে রণাঙ্গনে এগিয়ে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে তাঁর দুই সন্তান শহীদ হন। নয় মাসের যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়ে গর্বিত ছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধুর খুনিকে ফেরানোর দায়িত্ব পেয়ে নির্ভয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম। তাই তো সেদিন বিমানঘাঁটিতে বজলুল হুদার হুমকি বা তিন বছর পর জিম্বাবুয়েতে তাঁর ছোট বোন আজিজ পাশার স্ত্রীর হুমকিকে তুচ্ছজ্ঞান করেছিলাম। কারণ, জন্মেছি যখন মরতে তো হবেই। ভয় পেলে লাভ কী? যে দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে, সেটা করার জন্য শেষ পর্যন্ত লেগে থাকি। হয়তো এই প্রত্যয়ের কারণে সেদিন কাজটি সম্ভব হয়েছিল।’