ঢাকা জেলা পরিষদের ৭৭% প্রকল্পের হদিস মেলেনি

উন্নয়নমূলক কাজের আওতায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ঢাকা জেলা পরিষদের তহবিল থেকে ঢাকার ধামরাই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ের সরঞ্জাম কেনার জন্য দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেখানো হয়। কিন্তু ওই দপ্তর কোনো অর্থ বা আসবাব পায়নি বলে প্রথম আলোকে বলেছেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাকির হোসেন।
ঢাকা জেলা পরিষদের বেশ কিছু প্রকল্পের বিষয়ে এ রকম অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নামে প্রথম আলো। দৈবচয়নের ভিত্তিতে ১৭৫টি প্রকল্পের বিষয়ে সরেজমিেন তথ্যানুসন্ধান করা হয়। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ প্রকল্পের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ১৬ শতাংশ প্রকল্পের ঠিকানা পাওয়া গেলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কোনো টাকা পাননি। ৭ শতাংশ প্রকল্পের সুবিধাভোগীরা বরাদ্দের অর্ধেক বা তার চেয়ে কম টাকা পেয়েছেন। এই ১৭৫টি প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ দেখানো আছে ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
২০১১-১২, ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪—এই তিন অর্থবছরে কাগজে-কলমে ৬ হাজার ৪৮৬টি প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখিয়েছে ঢাকা জেলা পরিষদ। বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ৪৪৭ কোটি ৭৯ লাখ ৯৯ হাজার ১৩৮ টাকা। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দিয়েছে ২১১ কোটি ৭০ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বাকি টাকা এসেছে পরিষদের নিজস্ব তহবিল, অনুদান ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ থেকে। প্রথম বছরে ১ হাজার ৫৪৬টি, দ্বিতীয় বছরে ২ হাজার ৬৯৫টি এবং তৃতীয় বছরে ২ হাজার ২৪৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের তথ্য দেওয়া হয়েছে ঢাকা জেলা পরিষদ থেকে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এসব প্রকল্পের মধ্যে ছিল মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তা, ঈদগাহ মাঠ, পাঠাগার, ক্লাব বা সংঘের সংস্কার ও উন্নয়ন, কম্পিউটার বিতরণ, সেলাই প্রশিক্ষণ, সেলাই মেশিন ও আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ বিতরণসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন।
ঢাকা জেলা পরিষদের অসহযোগিতার কারণে এসব প্রকল্পের বিষয়ে সাংবাদিকতার স্বাভাবিক নিয়মে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। পরে এ বিষয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে প্রথম আলো। এরপরও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। নিয়মানুযায়ী আপিল করা হয়। আপিলেও তথ্য না মেলায় তথ্য কমিশনে অভিযোগ করা হয়। শুনানি শেষে কমিশন চাহিদা অনুযায়ী প্রথম আলোকে তথ্য সরবরাহ করতে জেলা পরিষদকে নির্দেশ দেয়। এরপর পরিষদ তিন অর্থবছরের উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকা সরবরাহ করে। এই প্রক্রিয়া শেষ করতে প্রায় এক বছর লেগে যায়।
এরপর তালিকা ধরে সরেজমিেন অনুসন্ধানে নামে প্রথম আলো। আট মাস ধরে দৈবচয়নের ভিত্তিতে সাভার ও ধামরাই উপজেলার ১৭৫টি প্রকল্প সরেজমিনে তথ্যানুসন্ধান করা হয়। কিন্তু ১৩৫টি প্রকল্পেরই সন্ধান পাওয়া যায়নি; শতকরা হিসাবে যা ৭৭ ভাগ। এ প্রকল্পগুলোর জন্য ২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। ২৮টি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে; যা অনুসন্ধান করা প্রকল্পের ১৬ শতাংশ। সেগুলোর অনুকূলে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৪১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান ও কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁরা কোনো অর্থ পাননি। ১২টি প্রতিষ্ঠান বরাদ্দের অর্ধেক টাকা পেয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছে। পরিষদের সরবরাহ করা তথ্য অনুযায়ী, এই ১২ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
প্রথম আলো যে ১৭৫টি প্রকল্প সরেজমিনে খতিয়ে দেখেছে সেগুলোর মধ্যে ৬৪টি ক্লাব বা সংঘ, ৫৭টি মন্দির, ৪০টি মাদ্রাসা, ৬টি মসজিদ, ৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ২টি সরকারি দপ্তর, ২টি রাস্তা, ১টি পাঠাগার মাঠ রয়েছে। অনুসন্ধানকালে ৬৪টি ক্লাব বা সংঘের একটিরও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। ৫৭টি মন্দিরের মধ্যে ৩২টি, ৪০টি মাদ্রাসার মধ্যে ৩৯টি এবং ১টি পাঠাগারের কোনো হদিস মেলেনি।
ঠিকানা অনুযায়ী ২৮টি প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে জেলা পরিষদ থেকে বরাদ্দ পাওয়ার বিষয়ে তারা কিছু জানে না বলে প্রথম আলোকে জানায়। ১২টি প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেছে যারা কিছু অর্থ পেয়েছে, যা মোট অনুসন্ধান করা প্রকল্পের মাত্র ৭ শতাংশ। তাদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, প্রাপ্ত অর্থ মোট বরাদ্দের প্রায় অর্ধেক। বাকি টাকা কে নিয়েছে, তা তারা জানে না।
ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক হাসিনা দৌলা গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে, এটা সত্য। তবে আমি এর সঙ্গে যুক্ত নই। দুর্নীতি করে থাকলে করেছেন পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।’
২০১৩-১৪ অর্থবছরে ঢাকা জেলা পরিষদ থেকে বাস্তবায়ন করা বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদক পরিষদের কয়েকজন প্রকৌশলী, হিসাবরক্ষক, অফিস সহকারী ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা দায়ের করেছে। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ রাজধানীর গুলশান ও তেজগাঁও এবং ঢাকার সাভার, আশুলিয়া, দোহার, নবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন থানায় এ মামলাগুলো করেছে।
পরিষদের দেওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ঢাকা জেলা পরিষদের বাস্তবায়ন করা ১৩৭টি প্রকল্পের বিপরীতে ২ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেকের মাধ্যমে গ্রহণ করেছেন জনৈক মনির। তিনি জেলা পরিষদের প্রশাসক হাসিনা দৌলার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। তবে মনিরের পূর্ণ নাম-ঠিকানা পরিষদ সরবরাহ করেনি।
এই মনিরের বিষয়ে জানতে চাইলে হাসিনা দৌলা বলেন, মনিরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয় ধামরাইয়ের সাবেক সাংসদ ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বেনজির আহমেদের মাধ্যমে। সে সূত্রে জেলা পরিষদে মনিরের যাতায়াত ছিল। আর ওই সুযোগে পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে মনির দুর্নীতি করে থাকতে পারেন।
জানতে চাইলে বেনজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকার ছেলে হিসেবে মনিরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। আমি হাসিনা দৌলার সঙ্গে মনিরের পরিচয় করিয়ে দিই, এটা সত্য। হাসিনা দৌলা মনিরকে প্রথম তাঁর মাইক্রো ইলেকট্রনিকস কোম্পানিতে চাকরি দেন। পরে জেলা পরিষদের প্রশাসকের দায়িত্ব পাওয়ার পর মনিরকে একান্ত সহকারী করেন। সেই সুবাদে হাসিনা দৌলা ও মনির কিছু করে থাকলে তার দায়দায়িত্ব তো তাঁদের।’
জেলা পরিষদের সরবরাহ করা তথ্যমতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ধামরাই থানার কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু ধামরাই থানার তখনকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, বরাদ্দের তথ্য জানার পর জেলা পরিষদসহ সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেও ভবনটি নির্মাণ করানো যায়নি। সম্ভবত কেউ সে টাকা তুলে নিয়ে গেছেন।
পরিষদের সরবরাহ করা কাগজপত্রে শুধু দরপত্র নম্বর লেখা আছে। ঠিকাদারের নাম-ঠিকানা লেখা নেই। কে টাকা তুলেছেন, তারও উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে তথ্য চাইলে আবার তথ্য অধিকার আইনে আবেদনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে পরিষদ থেকে।
আবার সাভারের কাতলাপুরের কানাইলালের আখড়ায় গত চার অর্থবছরে ৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেখানো হয়েছে জেলা পরিষদের কাগজপত্রে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ সম্পাদক নিতাই দয়াল দাস প্রথম আলোকে বলেন, তিন দফায় তাঁদের মাত্র ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। ওই টাকাও অনেক তদবির করে আদায় করতে হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্প অনুমোদনের আগে উপজেলা পরিষদ থেকে জেলা পরিষদে প্রস্তাব পাঠানোর কথা। এরপর জেলা পরিষদের সমন্বয় কমিটি প্রকল্প চূড়ান্ত করবে। উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তাসহ একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি সমন্বয় কমিটির সদস্য হবেন। জেলা পরিষদের প্রশাসক পদাধিকারবলে কমিটির সভাপতি হবেন। এই কমিটি প্রকল্প অনুমোদের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে জেলা পরিষদ তা বাস্তবায়ন করবে।
ঢাকার সাভার উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আমি চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলাম। ওই সময়ে সাভার উপজেলা পরিষদ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের কোনো প্রস্তাব জেলা পরিষদে পাঠানো হয়নি। জেলা পরিষদ থেকেও কোনো প্রস্তাব চাওয়া হয়নি। সমন্বয় কমিটির কোনো সভায়ও আমাকে ডাকা হয়নি।’ ফিরোজ কবীর দাবি করেন, পরিষদের প্রশাসক এককভাবে প্রকল্পগুলো চূড়ান্ত করেছেন।
ঢাকার তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেছেন, ঢাকা জেলা পরিষদ থেকে গত পাঁচ বছরে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেগুলো নিয়ম অনুযায়ী চূড়ান্ত করা হয়নি। প্রকল্প চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যানদেরও ডাকা হয়নি। ফলে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

 ১৬% প্রকল্পের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে; তবে সংশ্লিষ্টরা কোনো টাকা পায়নি
 ৭% প্রকল্পে বরাদ্দের অর্ধেক টাকা দেওয়া হয়েছে

‘‘দুর্নীতি ও অনিয়ম
হয়েছে, এটা সত্য। তবে আমি এর সঙ্গে যুক্ত নই। দুর্নীতি করে থাকলে করেছেন পরিষদের
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
হাসিনা দৌলা
ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক