ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রনাথ

১৯২১ সালের ১ জুলাই পাঠদানের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। দেশের সবচেয়ে বড় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে বিশেষ লেখা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। আমাদের দেশে যতগুলো সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তার মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে এবং শিক্ষার মান বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান শীর্ষে। শিক্ষাদান ছাড়াও নানান বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, আন্দোলন এবং স্বাধিকার অর্জনের প্রত্যয়েও সদা মানবিক ও সোচ্চার থেকেছেন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। একসময় এটিকে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলা হতো। এ বছর আমাদের প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ বছর পূর্তি। ১৯২০ সালে বঙ্গীয় আইনসভা বা বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার আইনি ভিত্তি লাভ করে। ১৯২১ সালের ১ জুলাই পাঠদানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে এই বিদ্যায়তন। ৮৭৭ জন ছাত্র এবং কলা, বিজ্ঞান ও আইন—এই ৩টি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে ছিল সূচনাপর্ব। প্রথম উপাচার্য ছিলেন মি. পি জে হার্টগ। প্রথম সমাবর্তন হয়েছিল ১৯২৩ সালে। শুরুর বছরগুলোয় শিক্ষক ও ছাত্রদের বড় অংশই ছিল হিন্দুধর্মাবলম্বী। আজ পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাখ লাখ ছাত্র শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই কেটেছে আমার শিক্ষাজীবনের শেষ পর্ব। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অনেক কথা ও তথ্য জেনেছি, এখনো জানতে ইচ্ছা হয়।

কবিগুরুর জন্মের ১৬০ বছর পূর্তির বছর ২০২১। কালের যাত্রাপথ অতিক্রম করতে করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম দিয়েছে বিশ্বমানের অনেক মানুষ। এ শিক্ষাঙ্গনের প্রাঙ্গণ বহু মনীষীর পদচারণের সাক্ষী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

কারও কারও মধ্যে একটি ধারণা আছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কলকাতার ওই প্রভাবশালী মহলের একজন, যাঁরা ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই কি রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং বইয়ে যা পাওয়া যায়, তা থেকেই আমাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে।

রবীন্দ্রনাথের চিঠি ও সনদ

সম্প্রতি সস্ত্রীক বেড়াতে গিয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত পতিসরে। পতিসর কাছারিবাড়িতে বেশ কিছু ছবির মধ্যে দুটি ছবি—ছবি বলা ঠিক হবে কি না জানি না, একটি পত্র বা চিঠির ছবি এবং আরেকটি সনদের ছবি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে এটি দেখে আমি আলোড়িত হয়েছি। চিঠিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের তৎকালীন প্রভোস্ট রমেশ চন্দ্র মজুমদার, যিনি আর সি মজুমদার নামে পরিচিত এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছিলেন, তাঁর কাছে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি পত্র। এর তারিখ ১৬ মাঘ ১৩৩২ বঙ্গাব্দ। ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১৬ মাঘ সম্ভবত ইংরেজি ১৯২৬ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ হবে। এর আগে আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অনেক ছবি দেখেছি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কবিগুরুকে দেওয়া ডি-লিট উপাধির সনদ কখনো দেখিনি। আর সি মজুমদারকে লেখা চিঠিটিও এর আগে আমার দেখার সুযোগ হয়নি।

১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা তা ভালোভাবে নিতে পারেননি। এ পরিস্থিতিতে তাঁদের খুশি করার জন্যই ১৯১২ সালের ২১ জানুয়ারি তদানীন্তন ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ একটি মুসলিম প্রতিনিধিদলের কাছে অচিরেই ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বছরের সময়কার বা তার অব্যবহিত কিছু আগের কোনো মানুষই এখন আর বেঁচে নেই। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক কুলদা রায় তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, বিভিন্নজন ভিন্ন ভিন্ন কারণে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। পশ্চিম বাংলা ও বিহার অঞ্চলের কিছু মুসলমানও বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল ভিন্নতর। তাঁদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়টি তাঁদের বা তাঁদের সন্তানসন্ততিদের কোনো কাজে আসবে না। যদি কোনো উপকার হয়, সেটা হবে পূর্ব বাংলার মানুষেরই। যে মুসলিম জনগোষ্ঠী এ রকম চিন্তা করত, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মাওলানা আকরম খাঁ, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, মৌলভি আবুল কাশেম, মৌলভি লিয়াকত হোসেন প্রমুখ। তদানীন্তন পূর্ব বাংলারও বেশ কিছু মুসলমানের মধ্যে এমন ধারণা ছিল যে পূর্ব বাংলায় যথেষ্ট পরিমাণ ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পাস ছাত্র নেই, যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করে ওই টাকা দিয়ে পূর্ব বাংলায় আরও কিছু স্কুল ও কলেজ স্থাপন করলে এই অঞ্চলের মুসলিম ছেলেমেয়েদের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়ার সুযোগের পরিধিটা বাড়বে। তাঁরা আরও ভাবতেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কারণে মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার জন্য যে বাজেট সরকার থেকে আসে, তা অনেকাংশেই কমে যাবে। তবে নিঃসন্দেহে কলকাতার হিন্দু সমাজের কিছু লোক ছাড়া প্রায় সবাই ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।

কলকাতার যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি নিজেও বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বেশ সক্রিয় ছিলেন। সে কারণে অনেকেই মনে করতেন, রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেরও বিরোধী ছিলেন। জানা যায়, তখনকার কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজসহ একটি বড় জনগোষ্ঠী ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে ১০-১২টি প্রতিবাদ সভাও করেছিল। এর একটি ছিল কলকাতার গড়ের মাঠের প্রতিবাদ সভা। ওই সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভাপতিত্ব করেছিলেন বলে প্রচলিত আছে। ইতিহাসের স্বার্থেই এ কথার সত্যতা যাচাই হওয়া দরকার।

১৯১২ সালে সেই গড়ের মাঠের প্রতিবাদ সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের কেউই আজ আর বেঁচে নেই। ফলে ওই সভায় রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন কি না বা সভাপতিত্ব করেছিলেন কি না, এ তথ্য জানতে হলে ইতিহাসের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

১৯১২ সালের ২৮ মার্চ তারিখটি ১৩১৮ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের সঙ্গে মিলে যায়। ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ ছিল ১৩১৮ বঙ্গাব্দের ১৪ বা ১৫ চৈত্র। তবে ইতিহাস বলছে, রবীন্দ্রনাথ ওই সময় ছিলেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গের শিলাইদহে। শিলাইদহ থেকে তিনি কলকাতায় ফিরেছিলেন ১২ এপ্রিল ১৯১২। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সব কবিতা, পত্র ও প্রবন্ধের নিচে রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ করতেন। ওই সময় শিলাইদহে অবস্থানকালে তিনি ১৭-১৮টি কবিতা ও গান লেখেন। দেখা যায়, ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’ গানটি তিনি রচনা করেন শিলাইদহে; তারিখ ১৪ চৈত্র ১৩১৮ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি দিনপঞ্জি অনুযায়ী যা হয় ১৯১২ সালের ২৭ মার্চ। আরও একটি গান ‘এবার ভাসিয়ে দিতে হবে আমার এই তরী’—এটিও শিলাইদহে বসেই কবি লিখেছিলেন ১৩১৮ বঙ্গাব্দের ২৬ চৈত্র, ইংরেজি দিনপঞ্জি অনুযায়ী যা ১৯১২ সালের ৭ বা ৮ এপ্রিল। (সঞ্চয়িতা, অষ্টম মুদ্রণ, প্রতীক প্রকাশন সংস্থা, পৃষ্ঠা ৩৩১)।

ওপরের তথ্যাবলি বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ যেহেতু শিলাইদহে ছিলেন, তাই কলকাতার গড়ের মাঠের সভায় তাঁর উপস্থিত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে কবি এসেছিলেন শিলাইদহে একটু বিশ্রাম নিতে।

ঢাকায় রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা

পতিসর থেকে আমি আর সি মজুমদারকে কবির দেওয়া যে চিঠির প্রতিলিপি ছবি আকারে তুলে এনেছি, তার তারিখ ১৬ মাঘ, বঙ্গাব্দ ১৩৩২। এটি ইংরেজি ৩০ বা ৩১ জানুয়ারি ১৯২৬-এর সঙ্গে মিলে যায়। রবি ঠাকুরের সেই চিঠিটি এখানে অবিকল তুলে ধরা হলো:

‘ওঁ

কল্যাণীয়েষু,

ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করবার জন্যে দূত এসেছিলেন। তাঁদের বিশেষ অনুরোধে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্ব্বেই যাত্রা করতে প্রস্তুত হয়েছি। ৬ই তারিখে রাত্রে রওনা হয়ে গোয়ালন্দ থেকে তাঁদেরই জলযানে ভেসে পড়ব। ১০ই তারিখ পর্যন্ত তাঁদের আতিথ্য ভোগ করে কর্ত্তব্য অন্তে তোমার আশ্রমে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণ পালন করব। নইলে আমাকে দীর্ঘকাল ঢাকায় থাকতে হয়। আমার সময় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃস্থিত ঢাকার লোকের নিমন্ত্রণ কোনোমতেই উপেক্ষা করা উচিত বোধ করিনে। তাই দুই নিমন্ত্রণ ক্ষেত্রে আমার সময়কে বিভক্ত করে দিলুম। যে কয়দিন তোমাদের দেব স্থির করেছিলুম সে কয়দিন সম্পূর্ণই রইল। ইতি ১৬ মাঘ ১৩৩২।

শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’

লক্ষণীয় যে আর সি মজুমদারকে পাঠানো চিঠির এক জায়গায় কবি উল্লেখ করেছেন, ‘ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করবার জন্য দূত এসেছিলেন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃস্থিত ঢাকার লোকের নিমন্ত্রণ কোনোমতেই উপেক্ষা করা উচিত বোধ করিনে।’ চিঠির এই অংশের পূর্বে তিনি লিখেছেন, ‘১০ তারিখ পর্যন্ত তাঁদের (ঢাকার লোকের) আতিথ্য ভোগ করে কর্তব্য অন্তে তোমার আশ্রমে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণ পালন করব।’ এই পত্র থেকেই জানা যায়, কবিকে ঢাকার সাধারণ মানুষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল। তখনকার সময় ঢাকাকে প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা ছিল ঢাকার নবাবদের। দূত পাঠানোও তাঁদের দ্বারাই সম্ভব ছিল। কোনো রাজনৈতিক নেতা বা প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণ হলে সেটা কবি তাঁর চিঠিতে অবশ্যই উল্লেখ করতেন। তবে রাজনৈতিকভাবেও তখন ঢাকার নবাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। ঢাকায় আগমন, মিউনিসিপ্যালিটির গণসংবর্ধনা, নবাববাড়িতে তাঁর নিমন্ত্রণ ও তাঁদের বোটে রাত্রিযাপন—এসবই প্রমাণ করে, ঢাকার মানুষ ও নবাবেরা নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যথাযথ সম্মান দিয়েই বরণ করেছিলেন।

১৯২৬ সালে ঢাকায় কবিকে যেসব প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন সংবর্ধনা দিয়েছিল, তার মধ্যে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ, মুসলিম হল ছাত্র সংসদ, জগন্নাথ হল, জগন্নাথ কলেজ, হিন্দু মুসলিম সেবা সংঘ, ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিসহ অনেক সংগঠন।

রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন, এ কথা যদি সত্যি হতো, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এতগুলো সংগঠন তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় এবং গড়ের মাঠের কথিত সভার ১৪ বছরের মাথায় এত বিপুলাকার সংবর্ধনা দিত না। রবীন্দ্রনাথ কার্জন হলে ১০ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি সমসাময়িক সামাজিক অবস্থা, রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, ঢাকার সুধী সমাজ তা বহুদিন স্মরণে রেখেছে। এখনো সেই বক্তৃতার অনেক কথাই বেশ প্রাসঙ্গিক। সর্বোপরি ১৯৩৬ সালের জুলাই মাসের ২৯ তারিখ কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ডক্টর অব লিটারেচার বা ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করা হয়। কিন্তু কবি ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিময় পতিসরে তাঁকে দেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি-লিট উপাধি প্রদানের সনদের যে প্রতিলিপি আছে, তার নিচে সনদ প্রদানকারী হিসেবে উপাচার্য স্যার এ এফ রহমানের স্বাক্ষর রয়েছে। বলা দরকার, রবীন্দ্রনাথকে ডি-লিট উপাধি দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্যার এ এফ রহমানের একক সিদ্ধান্ত ছিল না, এটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের। আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য, ১৯৩৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় যাঁদের সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করে, তাঁদের মধ্যে শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই ছিলেন নোবেলজয়ী।

এই সব তথ্য-উপাত্তের আলোকে এটা প্রমাণিত হয় যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা তো করেনইনি, বরং এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর বন্ধন ছিল আমৃত্যু অটুট।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ, ঢাকা।