ঢাকা শহরকে কোথায় নিয়ে যাব
ঢাকা শহরকে আধুনিক, বিশ্বমানের এবং সব দিক থেকে মানবিক একটি শহর হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য আমাদের সবার। রাজউক প্রণীত ঢাকার বিশদ পরিকল্পনা (ড্যাপ, ২০১৬-৩৫) সেই লক্ষ্য অর্জনের ব্লু-প্রিন্ট। কঠিন বাধাগুলো পেরিয়ে আমাদের প্রাণের শহর ঢাকায় একটি উন্নত নগরজীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অভিনব চিন্তাভাবনা এবং এ নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক বা আবেগপ্রবণ কথামালার চর্চা অবশ্যই হতে পারে।
ড্যাপের বিস্তারিত দলিলে অনেকগুলো নতুন ভাবনাচিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। খসড়া পরিকল্পনাটি নিয়ে বিভিন্ন পেশাজীবী এবং বিশেষজ্ঞ সমালোচনার ঝড় তুলছেন। এসব মতামত রাজউক ধৈর্যসহকারে দেখবে আশা করি। তবে চলমান আলোচনা-সমালোচনায় কতগুলো জরুরি বিষয় এখনো আসছে না।
আমরা শহর নামক বন্দোবস্তে বাস করছি বটে, তবে শহরকে এখনো সম্পূর্ণভাবে আপন করে নিতে পারিনি। দেশ নিয়ে আমরা যতটা আবেগের সঙ্গে কথা বলি, শহর নিয়ে বলি না। আমাদের মানসিকতায় এখনো কবি জসীমউদ্দীনের মায়া-মমতায় জড়ানো সেই গ্রামভাবনা। আর শহরে হাজারো নেকড়ের বাস, কবি শামসুর রাহমান যেমন বলেছিলেন।
ঢাকার মতো সমস্যাজর্জরিত ও জটিল শহর খুব কমই আছে, তবু এই শহরই বলে দিতে পারে আমরা কী করে একসঙ্গে বসবাস করব। নগর থেকে নাগরিক—কীভাবে সমষ্টিগত কল্যাণ ও এককের দায়িত্বের সমঝোতা হবে? নগরবিদ জেমি লার্নারের কথায় বলতে হয়, শহর কোনো সমস্যা নয়, বরং কী করে সবাই মিলে একসঙ্গে থাকব, তার সমাধান।
একটা শহরের পুঞ্জীভূত সমস্যা যখন পাহাড়সম হয়ে দাঁড়ায়, তখন যথারীতি আর গতানুগতিক পন্থাগুলোও প্রকৃত উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তখন প্রয়োজন বড় ধরনের ভাবনা, কিছু অভিনব প্রস্তাব। ঢাকা শহরকে ২০৩৫ সাল নাগাদ কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়, নিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য পথগুলো কী হতে পারে, তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্রিত বর্ণনা তুলে ধরছি।
ঢাকার বৃহত্তর বৃত্ত, অন্দর-বৃত্ত
ঢাকার যে নগরময়তা, সেটা রাজউকের আইনি ও প্রশাসনিক সীমানার মধ্যে আবদ্ধ নয়। যদিও ড্যাপের এই আইনি গণ্ডি ধরেই রচিত হবে ঢাকা শহরের আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা। আমাদের মনে হয়, প্রথম থেকেই ড্যাপ এলাকাকে একটি বৃহৎ অঞ্চলের ধারণার সঙ্গে যুক্ত হওয়া দরকার। অনানুষ্ঠানিকভাবে এই অঞ্চলকে আমরা রাজউক পরিচালিত ঢাকার ‘বৃহত্তর বৃত্ত’ বলতে পারি।
রাজউক পরিচালিত ঢাকার পরিসীমার ভেতরও এমন সব এলাকা আছে, যেগুলো মেট্রোপলিটন ঢাকার সাপেক্ষে অর্ধনগর বা গ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এসব জায়গাকে রাজউক পরিচালিত ঢাকার ‘অন্দর-বৃত্ত’ হিসেবে ধরে নিতে পারি। ঢাকার জন্য সামগ্রিক, সম্পূর্ণ ও সুষম পরিকল্পনা করতে হলে এই দুই বৃত্তের ধারণা নিয়েই এগোতে হবে।
আমরা ২০১২-তে ‘ঢাকা নেক্সাস’ নামে একটি আঞ্চলিক পরিকল্পনার ধারণা প্রকাশ করেছিলাম। ঢাকার কেন্দ্র থেকে দুই ঘণ্টা যাতায়াত পথের ব্যাসার্ধের ভেতর জনবসতিগুলোকে নতুন গণপরিবহনব্যবস্থার ভেতরে এনে এক নতুন নগরমণ্ডলের কথা ভাবা যায়। এ ভাবনার ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানের সঙ্গে বহুকেন্দ্রিক ঢাকা পরিকল্পনার মিল আছে। বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন ধাপে নগরায়ণ নিয়ে এই নগরমণ্ডল অনেকগুলো সুফল বয়ে আনতে পারে। যেমন মেট্রোপলিটন এলাকায় জনবহুল কেন্দ্রগুলোকে বিকেন্দ্রীকরণ, জনঘনত্বের নতুন বিন্যাস ও নাগরিক সুবিধার বহুমাত্রিক উন্নতি। নেক্সাস নামক ঢাকা নগরমণ্ডলের ভেতরে পুরোনো নগরবিন্দুগুলোর উন্নয়ন তো হতেই পারে, নতুন করে এখানে নগর গঠনও ভাবা সম্ভব।
প্রথমে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার—বাজার অর্থনীতির চাপে আর ধাবমান অগ্রগতির নেশায় সব অঞ্চলের চিত্র কি একই রকম হবে, নাকি প্রতিটি এলাকার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রাকৃতিক ও সামাজিক প্রসারকে প্রাধান্য দিয়ে একটি পরিকল্পিত নগরায়ণ হবে?
রাজউক পরিচালিত ঢাকা ‘অন্দর-বৃত্ত’ বৈষম্যে পূর্ণ। ঢাকার ভবিষ্যৎ ও উন্নয়নের কথা যখন বলা হয়, তখন অজান্তেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মূলত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ—এই দুই সিটি করপোরেশনকে বোঝানো হয়। অথচ রাজউক পরিচালিত ঢাকার আওতায় আরও আছে আরও দুটি সিটি করপোরেশন, তিনটি পৌরসভা আর তাদের অন্তর্গত এলাকাসমূহ।
ঢাকার পরিকল্পনা চিন্তায় প্রথমেই থাকতে হবে এই মেট্রোপলিটন কোরের বাইরেও একটি বাড়ন্ত ঢাকা, যার মধ্যে পড়ছে বিভিন্ন নগর, বসতি, কৃষিজমি, নদী, জলাভূমি, বনাঞ্চল। প্রশ্ন হলো, এসব নিয়ে কী করা যায়? এ রকম একটা বিশাল ও বৈচিত্র্যময় ল্যান্ডস্কেপকে কি একতরফা ভূমি ব্যবহার নীতি দিয়ে বাঁধা যায়?
রাজউক পরিচালিত ঢাকার এই বিশাল ও বিভিন্নতায় ভরা অন্তর্বৃত্তীয় এলাকাকে চিন্তাধারায় না নিয়ে কীভাবে বিশদ পরিকল্পনা করা যায়? এই মিশ্র নগরায়ণকে কীভাবে কৌশলগত পরিকল্পনার আওতায় আনা যায়? ঢাকার পরিকল্পনা তৈরির ক্ষেত্রে এটাই প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ।
প্রথমে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার—বাজার অর্থনীতির চাপে আর ধাবমান অগ্রগতির নেশায় সব অঞ্চলের চিত্র কি একই রকম হবে, নাকি প্রতিটি এলাকার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রাকৃতিক ও সামাজিক প্রসারকে প্রাধান্য দিয়ে একটি পরিকল্পিত নগরায়ণ হবে?
উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, রাজউক এলাকার কৃষি জায়গাগুলো এ ক্ষেত্রে একটি বড় কনসেপচুয়াল চ্যালেঞ্জ। ড্যাপের প্রস্তাবিত মেট্রোপলিটন এলাকার কৃষিজমি প্রায় ৩০ শতাংশ। ঢাকার নগরময়তার সঙ্গে এই কৃষিজমির বোঝাপড়া কীভাবে হবে? এই কৃষিপ্রধান এলাকার সঙ্গে মেট্রোপলিটনের যে সম্পর্ক, এই দুইয়ের মধ্যে নতুন ও অভিনব ঐক্য সৃষ্টি করা দরকার। এর জন্য প্রয়োজন নগরতত্ত্বের নতুন ধ্যানধারণা।
পানি প্রবাহভিত্তিক নগরকাঠামো
আমরা জলজ জাতি। তবে শহরের বেলায় পানি নিয়ে ভাবতে আমাদের কুণ্ঠা। রাজউক ঢাকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেখানে একটা বিরাট অংশ পানিপ্রবাহের আওতায়। এর ভেতর রয়েছে নদী, খাল, জলাভূমি, রিটেনশন এলাকা, বন্যাপ্রবণ এলাকা। আগে আলোচিত কৃষিজমিও মূলত প্লাবন প্রভাবিত এলাকার অন্তর্ভুক্ত। ঢাকার একটি বড় অংশ প্লাবনভূমি এবং সক্রিয় জলস্রোতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, এখানকার জনজীবন, খাদ্যনিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য ও প্রাণ-পরিবেশ সবকিছুই এই জলপ্রবাহের সঙ্গে জড়িত।
নতুন ড্যাপে প্লাবন এলাকা নিয়ে আলোচনা আছে। কীভাবে ইমারত নির্মাণ করা যাবে বা যাবে না, এ বিষয়ে নির্দেশনা আছে। তবে প্লাবন এলাকাগুলো যে কোনো বিচ্ছিন্ন জায়গা নয়, বরং সামগ্রিক জলপ্রবাহের ফলাফল—এ রকম উপলব্ধি কম। এই জলস্রোতগুলোর উৎস ও ক্ষেত্র ড্যাপ এলাকার বাইরে পড়লেও এ নিয়ে কোনো গবেষণা ছাড়া পরিকল্পনা অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।
আমরা জোরালোভাবে বলতে চাই, মৌসুমি অঞ্চল ও গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের শহরগুলোর জন্য নতুন আঙ্গিকের জল-স্থল পরিকল্পনার চর্চা হওয়া উচিত। যেকোনো বড় ধরনের উন্নয়ন সঞ্চালিত হবে জল-স্থল ভাবনার আদর্শ থেকে। এ রকম পন্থায় কতগুলো বদ্ধমূল ও গতানুগতিক ধারণা পাল্টে দেখা দরকার। যেমন বন্যাকে শুধু দুর্যোগ না ভেবে পানির প্রবাহের বিভিন্ন ধাপ ভাবা যেতে পারে। ‘ল্যান্ড-ইউজ’ বা ভূমি ব্যবহার না বলে জল পরিব্যাপ্ত জায়গার জন্য ‘জল-স্থল ব্যবহারের’ কথা সূচনা করা যায়।
এই কথাগুলো নিছক কল্পনা নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে পানিপ্রবাহভিত্তিক উদ্ভাবনী ধারণা পরে পরিণত রূপ পেয়েছে। চীনের খ্যাতিমান ইকোলজিক্যাল ডিজাইনার ও পরিকল্পনাবিদ কঞ্জিয়ান ইউর ‘স্পঞ্জ সিটি’ ধারণার ওপর ভিত্তি করে অনেকগুলো শহর নতুন আঙ্গিকে রচিত হয়েছে, যেখানে পানিপ্রবাহ, ইকোলজিক্যাল গুরুত্ব ও সিভিক স্পেসের মিলন ঘটেছে।
বন্যা বন্ধু হতে পারে, পানির প্রবাহকে বাঁধ দিয়ে বাধা দিয়ো না—এমন চিন্তাভাবনা থেকে ইউ তাঁর ‘স্পঞ্জ সিটি’ রচনা করেছেন, যা কিনা এখন চীন সরকারের নগরনীতির একটি অংশ।
বৃহৎ ঢাকার পানির প্রবাহ অনুসন্ধান করে বেঙ্গল ইনস্টিটিউটের গবেষক আরফার রাজি দেখিয়েছেন, প্রধান নদীগুলো চারটা ওয়াটার-শেড এলাকা সৃষ্টি করে। পানির আধার, ছোট-বড় ধারা, স্রোতের গতি-প্রকৃতি—সবই নির্ভর করছে এই ওয়াটার-শেডের ওপর। এই ওয়াটার-শেডের ধরনটা বোঝা জরুরি এবং এই ধারণা থেকেই রাজউক পরিচালিত ঢাকার ভেতরে যেকোনো অবকাঠামোগত উন্নয়ন বা বড় মাপের নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। জলনিষ্কাশন তো বটেই, একবিংশ শতাব্দীতে একটি সুপরিকল্পিত শহর তৈরি করতে আমরা এ রকম কৌশলই আশা করি।
প্লাবন এলাকায় অবকাঠামো ও ইমারত নির্মাণের ব্যাপারে ড্যাপে নির্দেশনা আছে, তবে পানিপ্রবাহভিত্তিক বিশদ আলোচনা দরকার। তা ছাড়া বড় ধরনের বসতি নির্মাণের গঠননীতি, চালিকা কৌশল ও রূপকল্প দরকার। বেঙ্গল ইনস্টিটিউট সে রকম রূপচিত্র রচনা করেছে, যেখানে পানিপ্রবাহের অঞ্চল অক্ষুণ্ন রেখে তার পাড় ধরে নতুন ধাঁচের বাড়িঘর তৈরি করা যায়। বাড়িঘরগুলোর বৈশিষ্ট্য এমন হবে যে তা প্রবাহ অঞ্চলকে ঘিরে রাখবে এবং সংরক্ষণ করবে।
আমাদের শহরগুলোর উন্নয়নের জন্য আমাদের নিজস্ব নগরতত্ত্ব দরকার। তেমনি পানি নিয়ে বা পানি ঘিরে নতুন ধরনের কাঠামোগত উদ্ভাবন দরকার।
নদীর পাড় ও খালের পাড় খুবই সংবেদনশীল জায়গা। সুযোগ পেলেই আমরা নদী, খালের পাড় তছনছ করছি, দখল করছি, ভরাট করছি বা আবর্জনায় ভাগাড় বানাচ্ছি। পানির দেশে পানির মহত্ত্ব অগ্রাহ্য করছি। এই অঘটনটা ঘটছে, কারণ, ঢাকাবাসী জানে না শহর-নগরের ভেতরে নদী বা খাল ধরে কী হবে, কোন ধরনের উন্নয়ন সবার জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।
আমরা মনে করি, এর জন্য কতগুলো চাক্ষুষ দ্রষ্টব্য বা নমুনা স্থাপন করা দরকার, যেগুলো সর্বসাধারণের মধ্যে আশা ও অনুপ্রেরণা জোগাবে।
সাশ্রয়ী গণযোগাযোগব্যবস্থা
বলার অপেক্ষা রাখে না, যেকোনো আধুনিক শহরের বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে উন্নত গণযোগাযোগব্যবস্থা প্রয়োজন। ড্যাপের বিশাল এলাকার আওতায় প্রায় দুই কোটি মানুষের সমাগম ও চলাচল। এই মহামণ্ডলকে সচল রাখতে আধুনিক গণযোগাযোগব্যবস্থা একেবারে জরুরি।
সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগব্যবস্থায় জোর দিচ্ছে এবং নির্মাণে ব্রত হয়েছে। এর ভেতর এমআরটি বা চক্রাকার রেলপথ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকাবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন এই ব্যবস্থা চালু হবে। এর মতো আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা শুধু মানুষের চলাচলের বাহন নয়, এগুলো শহরের গুণগত বিকাশ ও অঞ্চলগত উন্নয়নের প্রভাবক।
নদীর পাড় ও খালের পাড় খুবই সংবেদনশীল জায়গা। সুযোগ পেলেই আমরা নদী, খালের পাড় তছনছ করছি, দখল করছি, ভরাট করছি বা আবর্জনায় ভাগাড় বানাচ্ছি। পানির দেশে পানির মহত্ত্ব অগ্রাহ্য করছি। এই অঘটনটা ঘটছে, কারণ, ঢাকাবাসী জানে না শহর-নগরের ভেতরে নদী বা খাল ধরে কী হবে, কোন ধরনের উন্নয়ন সবার জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।
এমআরটির মতো রেলপথে স্টেশন ও স্টেশন এলাকার বিকাশ একটি সাধারণ স্বীকৃত কৌশল। তবে এ ব্যাপারে ড্যাপ খসড়ায় বিশদ আলোচনা পাই না। টোকিও শহর সেই ষাটের দশকে এবং সম্প্রতি সিঙ্গাপুর ও ব্যাংকক প্রতিটি শহর নতুনভাবে বিকশিত হয়েছে গণযোগাযোগ লাইনের স্টেশন ধরে।
ব্যাংকক প্ল্যানে স্টেশনভিত্তিক এলাকা বা পাড়ার উন্নয়ন পরিকল্পনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। যত্রতত্র দালানকোঠা নির্মাণ ঠেকাতে স্টেশন এলাকায় কী ধরনের বাড়িঘর হবে, কোথায় হবে, তা ছাড়া এলাকার মানুষ কীভাবে যুক্ত হবে, তার স্পষ্ট পরিকল্পনা দরকার।
ব্যবহারের দিক থেকে সফল এমআরটির জন্য প্রয়োজন স্টেশনে যাত্রীদের আসার সুবিধাজনক পথ। শুধু রেলপথ ও স্টেশন তৈরি যথেষ্ট নয়, এলাকার মানুষজন যাতে অনায়াসে স্টেশনে আসা-যাওয়া করতে পারে, তার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পদচারী ব্যবস্থা। তা ছাড়া স্টেশনে আসা-যাওয়ার জন্য সংলগ্ন পাড়া-এলাকাজুড়ে দরকার পরিকল্পিত এলাকাভিত্তিক পরিবহন লুপ।
হাউজিংই শহরের গঠন
হাউজিং অবশ্যই শহরের প্রাথমিক প্রয়োজন। তবে ঢাকা শহরের হাউজিং বড় হতাশাব্যঞ্জক। সমতা, সামাজিকতা ও গোষ্ঠীবদ্ধ হওয়া বলতে যা বোঝায়, তা হাউজিংয়ের গঠন দিয়েই পরিচালিত হয়। হতাশার ব্যাপার এই যে ঢাকার তথাকথিত হাউজিংগুলোতে এই চরিত্রগুলোর খুবই অভাব। যা আছে, তা প্লটভিত্তিক স্বতন্ত্র বাড়িঘরের নিজস্বতার বাহার।
আমরা বহু দিন ধরে বলে আসছি, প্লটভিত্তিক পরিকল্পনা করে একটা সিভিক ও সামাজিক শহর তৈরি করা যায় না। প্লট, প্রাচীরঘেরা নিজ নিজ বাড়ি দিয়ে সমাজ বা পাড়া গঠন হয় না। এখন পর্যন্ত আমরা এই প্লটের বাইরে আবাসন বা গৃহায়ণ নকশা ভাবতে পারি না। এই প্রথা চালু রাখার দাবিদার অবশ্যই রাজউক। ড্যাপের খসড়ায় তাই ব্লক হাউজিংয়ের প্রস্তাব বেশ আশাব্যঞ্জক।
তবে ব্লক হাউজিং ব্যাপারটা কী? এর ধরনধারণ কেমন, কত রকম হতে পারে, সুবিধাগুলো কী কী? এটা সাধারণ মানুষকে বোঝানোর প্রয়োজন আছে। তা ছাড়া একটি বড় রকমের চ্যালেঞ্জ হলো, ঢাকা শহরে পরিকল্পিত গৃহায়ণ এখনো রাজউকের প্লট প্রথায় বন্দী। সেখান থেকে বের হয়ে আসার পথ কে দেখাবে? শুরুটা রাজউককেই করতে হবে।
এমআরটির মতো রেলপথে স্টেশন ও স্টেশন এলাকার বিকাশ একটি সাধারণ স্বীকৃত কৌশল। তবে এ ব্যাপারে ড্যাপ খসড়ায় বিশদ আলোচনা পাই না। টোকিও শহর সেই ষাটের দশকে এবং সম্প্রতি সিঙ্গাপুর ও ব্যাংকক প্রতিটি শহর নতুনভাবে বিকশিত হয়েছে গণযোগাযোগ লাইনের স্টেশন ধরে।
ব্লক হাউজিংকে অন্যভাবে বোঝার উপায় হচ্ছে আরবান ফরম। অর্থাৎ একটা ছোট এলাকা ধরে বাড়িঘরের বিন্যাস দিয়ে মানুষ কীভাবে একত্র হবে। ব্লক হাউজিং বা আরবান ফরমের ধরন দিয়ে নির্ধারিত হতে পারে জনঘনত্ব, সর্বজনীন সাধারণ পরিসরের ব্যবহার, নাগরিক সুবিধাসংবলিত বাসস্থান ব্যবস্থা ও পরিবেশগত উৎকর্ষ।
তবে এ ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, গৃহায়ণের এই ধরন কীভাবে ঘনবসতিপূর্ণ ও বর্তমানে নির্মিত এলাকায় প্রয়োগ করা যাবে। জুরাইন, বাসাবো বা শেওড়াপাড়ার মতো জায়গায় যেখানে জমির মালিকানার প্রকৃতি বেশ জটিল, সেসব এলাকায় কীভাবে ব্লক হাউজিংয়ের ধারণা প্রবর্তন করা যায়? জটিল হলেও নগরকে বাসযোগ্য করতে নতুন ভাবনা ভাবতে হবে। যেমন মালিকানার অংশের ওপর ভিত্তি করে জমিগুলোকে একত্র করে গুচ্ছ আবাসন তৈরি করা যেতে পারে।
পাবলিক স্পেস শহরের জীবন
বাড়িঘর, দালানকোঠা যতই জাঁকজমকপূর্ণ হোক না কেন, সেগুলোর সমষ্টিকে কখনোই একটি সফল শহর বলা যায় না। আদর্শ শহর মানে বাড়িঘর আর জনপরিসর বা পাবলিক প্লেসের বুনন।
যেকোনো মানবিক ও সিভিক শহরের প্রতীক হলো শহরের জনপরিসর। দুর্ভাগ্যবশত, পাবলিক স্পেস বা জনপরিসরের কথা শহর নিয়ে তর্ক-বিতর্কেও অবর্তমান। ড্যাপ খসড়াতেও এর বিশেষ আলোচনা নেই।
ইরানের ইস্পাহান শহরের ময়দান-ই-শাহ, ভারতের কলকাতার গড়ের মাঠ, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্ক বা ইতালির ভেনিসের সেন্ট মার্কস স্কয়ার—এ রকম মাপের জনপরিসর ঢাকা শহরে নেই। এমনকি পাড়াভিত্তিক জনপরিসরেরও বড় অভাব। যতটুকু ছিল, যেমন সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা, সেখানেও এখন জনগণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। শাহবাগ প্রতিবাদ বা জটলা করার জায়গা হতে পারে, তবে চার রাস্তার ক্রসিং কোনোভাবেই জনপরিসর নয়। একে বড়জোর গণপরিসর বলতে পারি।
জনপরিসর পরিকল্পিতভাবে তৈরি করতে হয়, সাধারণ মানুষের ব্যবহারোপযোগী করে তুলতে হয়। ড্যাপ খসড়ায় খোলা জায়গার কথা বলা আছে, কোথায় সেই খোলা জায়গা হবে, সেটার নির্দেশনা আছে। তবে খোলা জায়গা মানেই জনপরিসর নয়। বন এলাকা জনপরিসর নয়, দুটো বাড়ির মধ্যে সেট ব্যাক জনপরিসর নয়। আবার অন্যদিকে ফুটপাত হলো সত্যিকার জনপরিসর।
আমরা মনে করি, সামাজিকভাবে কার্যকর ও মানবিক শহর তৈরি করতে হলে জনপরিসর নিয়ে আরও নিষ্ঠার সঙ্গে ভাবনাচিন্তা এবং যথাযথ প্রস্তাব তৈরি করা দরকার। এ জন্য চাই জনপরিসর ধারণাটির প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি স্বীকৃতি। এর সঙ্গে চাই জনপরিসর তৈরি ও ব্যবহারের বিশেষ বিধিমালা। তবেই ঢাকা শহর সবার জন্য হয়ে উঠবে প্রাণোচ্ছল ও মানবিক।
লেখক: স্থপতি, মহাপরিচালক, বেঙ্গল ইনস্টিটিউট ফর আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপস অ্যান্ড সেটেলমেন্টস