
ছেলে দুটি পড়াশোনার পাশাপাশি সবজি বিক্রি করেছে। আর দুই মেয়ের একজনের বাবা পত্রিকার হকার, অন্যজনের বাবা আইসক্রিম বিক্রেতা। এদের কোনো দিন হয় না বাজার। তখন রান্নাবান্না বন্ধ, আহার জোটে না। তবু এরা পড়াশোনা করে। আর একের পর এক ছিনিয়ে আনে সাফল্য। এরা এবারের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে।
সাবিহার বাবা পত্রিকার হকার
প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পত্রিকা বিক্রি করেন হোসেন আলী। এতে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে চলে পাঁচজনের সংসার। তিন ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগান। তাঁর বাড়ি যশোর সদর উপজেলার আড়পাড়া গ্রামে। টাকার অভাবে তাঁর বড় মেয়ে সাবিহা খাতুন বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে হেঁটে স্কুলে যেত। প্রয়োজনীয় বইপত্র বাবা তাকে কিনে দিতে পারেননি। এমন টানাটানির সংসারে থেকেও সে বারবার ভালো ফল করেছে। সে এবার উপজেলার বাহাদুরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ পেয়েছিল।
সাবিহার বাবা হোসেন আলী বলেন, ‘আমি নিজে লেখাপড়া শিখতে পারিনি বলে দুঃখ আছে। তবে আমার তিন ছেলে-মেয়েকে উচ্চতর পড়াশোনা করিয়ে সেই দুঃখ দূর করতে চাই।’
বাবার সঙ্গে সবজি বিক্রি করত শাহিদুল
হতদরিদ্র শাহিদুল ইসলাম বাবার সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে সবজি বিক্রি করত। সে এবার উল্লাপাড়া মার্চেন্টস পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। সে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার শ্রীকোলা গ্রামের আবদুল হান্নানের ছেলে।পাঁচ সদস্যের সংসার। বাড়ির চার শতক ভিটে ছাড়া জমিজমা নেই। অভাবের সংসারে পড়াশোনা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। শাহিদুল যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, তখন থেকেই সে বাবার সঙ্গে সবজি বিক্রি শুরু করে।
শাহিদুল বলে, টাকার অভাবে প্রাইভেট পড়া হয়নি। তবে শিক্ষকেরা তাকে নানাভাবে সহযোগিতা দিয়েছেন। পিইসিতেও সে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। তার স্বপ্ন প্রকৌশলী হওয়ার। আবদুল হান্নান বলেন, সবজি বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালিয়ে তিন সন্তানের পড়াশোনার খরচ জোগানো কঠিন।
মা নাছিমা খাতুন বলেন, ছেলেটা অনেক দিন না খেয়ে ইশকুলে গেছে। কোনো দিন ভালো কাপড়চোপড় পরতে পারেনি। তারপরও লেখাপড়া ছাড়েনি।

ময়ূরী আইসক্রিম বিক্রেতার মেয়ে
ময়ূরী খাতুন চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার খোসালপাড়ার আইসক্রিম বিক্রেতা মো. জেন্টুর মেয়ে। সে এবার গোমস্তাপুর আবদুল হামিদ বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। এর আগে সে পিইসি ও জেএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিল।
জেন্টু বলেন, প্রতিদিন সকালে বের হয়ে আইসক্রিম বিক্রি করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন। হাটবারে রাত হয়ে যায়। রোজ বড়জোর ৩০০ টাকা আয় হয়। এ দিয়ে খেয়ে না-খেয়ে দিন চলে। তিন মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ছোট মেয়ে পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। মেজ ময়ূরীই সবচেয়ে মেধাবী। তাকে নিয়েই তিনি স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ হবে কি না, তিনি জানেন না।
ময়ূরী বলে, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে সে উচ্চতর পড়াশোনা করতে চায়। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। তা ছাড়া তাকে অষ্টম শ্রেণি থেকে বিনা পয়সায় ইংরেজি পড়িয়েছেন প্রতিবেশী ও বাইলকাপাড়া আলিম মাদ্রাসার ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক আবদুল আহাদ।
কুপির আলোয় পড়ত রবিউল
রাজবাড়ী সদর উপজেলার বরাট ভাকলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে একমাত্র জিপিএ-৫ পেয়েছে রবিউল হাসান। সে গোয়ালন্দ উপজেলার ছোটভাকলা গ্রামের আমজাদ খানেরছেলে। প্রায় ১০ বছর আগে দৌলতদিয়ার কুশাহাটা গ্রামে নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। পরে ছোটভাকলা গ্রামে এক খণ্ড জমির ওপর একটি টিনের ঘর তুলে বসবাস শুরু করেন।
আমজাদ খান বলেন, ‘আমি হাটবাজারে মহাজনের কাছ থেইকা কিছু সবজি কিইন্না বেচি। ১০০-২০০ টাহা লাভ থাহে। তাই নিইয়া পোলাপানগো নিয়া চলি। মাঝেমধ্যে রবিউল বাজারে এসে দোহানে বসত। এর মধ্যি আমার পোলা যে এত ভালো ফল করব, স্বপ্নেও চিন্তা করি নাই। আমি বেজায় খুশি।’
রবিউল বলে, বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। তাই সন্ধ্যার পর বাজার থেকে বাড়ি ফিরে কুপি জ্বালিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করত। ভবিষ্যতে প্রকৌশলী হতে চায় সে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর অফিস, সিরাজগঞ্জ ও গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) প্রতিনিধি]