তরুণদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, বেশি লাঞ্ছনা–যৌন নিপীড়ন
বাংলাদেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা বাড়ছে। গত তিন বছরে এ প্রবণতা বাড়ার হার সবচেয়ে বেশি। অপরাধের মধ্যে যৌন হয়রানি ও লাঞ্ছনার ঘটনা বেশি। অঞ্চল হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে তরুণদের সহিংস ঘটনা সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে ময়মনসিংহ ও সিলেটে সবচেয়ে কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা, সুস্থ বিনোদনের অভাব, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তরুণদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির (বিপিও) উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) করা একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশের শান্তি পরিস্থিতি ২০২১’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৫ কোটি ৯০ লাখ তরুণ জনগোষ্ঠী আছে। এরা জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ। বর্তমান বিশ্বে তরুণদের সহিংস কর্মকাণ্ড একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তরুণদের এই বয়সটা হচ্ছে উপভোগের সময়। একটি সমাজে যখন সুস্থ বিনোদন না থাকে, তখন তরুণেরা অপসংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ে।অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক, চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশেও একইভাবে কিশোর গ্যাং, হামলা, চুরি, ছিনতাই, যৌন অপরাধী হিসেবে তরুণেরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ২৬টি ক্যাটাগরিতে দেশের অপরাধচিত্র বিশ্লেষণ করে থাকেন। তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনুযায়ী তাঁদের অপরাধের বিষয়গুলোও তুলে ধরা গুরুত্বপূর্ণ। তরুণদের অপরাধে জড়িয়ে পড়া সারা বিশ্বেই বেড়েছে। সে হিসেবে বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশের তরুণদের সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে দুর্বল পুলিশিং এবং অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়ার প্রবণতাকে দায়ী করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।
প্রতিবেদনে তরুণ হিসেবে ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের ধরা হয়েছে। গবেষণায় ছেলে, মেয়ে, শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গ্রুপ, তরুণ, তরুণদের বিভিন্ন গ্রুপ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরকে অপরাধী ও ভুক্তভোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এ ছাড়া তরুণদের সহিংসতা হিসেবে হামলা, যৌন নিপীড়ন, ভাঙচুর, বাস ধ্বংস, মারামারি, দলবদ্ধ সহিংসতা, অস্ত্রের ভয় দেখানো, অপহরণকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে তরুণ হিসেবে ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের ধরা হয়েছে। গবেষণায় ছেলে, মেয়ে, শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গ্রুপ, তরুণ, তরুণদের বিভিন্ন গ্রুপ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরকে অপরাধী ও ভুক্তভোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এ ছাড়া তরুণদের সহিংসতা হিসেবে হামলা, যৌন নিপীড়ন, ভাঙচুর, বাস ধ্বংস, মারামারি, দলবদ্ধ সহিংসতা, অস্ত্রের ভয় দেখানো, অপহরণকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
বিপিও বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে আশঙ্কাজনকভাবে যুব সহিংসতা বাড়ছে। শুধু ঢাকাতেই প্রায় ৭০টি ‘কিশোর গ্যাং’ সক্রিয় রয়েছে। তারা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক পাচার, এমনকি খুনের মতো অপরাধে জড়িত। সাইবার প্রযুক্তি তরুণদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়াকে আরও সহজ করেছে।
বিপিওর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সাল থেকে তরুণদের সহিংস প্রবণতা বেড়েছে। ২০১৯ সালে ২ হাজার ৪১১টি যুব সহিংস ঘটনা, ২০২০ সালে ২ হাজার ৩৬৩টি ঘটনা এবং ২০২১ সালে তা কিছুটা কমে হয় ১ হাজার ৮৯৬টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনাগুলো ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কখনো কমেছে এবং কখনো বেড়েছে। তবে তা কখনোই ১ হাজার ৫০০ ছাড়ায়নি। কিন্তু ২০১৯ সালে হঠাৎ বেড়ে যায়। তিন বছরে দেশে অন্তত ৩ হাজার ৯২২ কিশোর-কিশোরীকে হিংসাত্মক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যৌন নিপীড়নের ঘটনায় তরুণদের সম্পৃক্ততা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ২০২১ সালে তরুণ জনগোষ্ঠী সংশ্লিষ্ট সহিংসতার বেশির ভাগই ছিল লাঞ্ছনা, যা ৫৪ দশমিক ৭ শতাংশ এবং যৌন নিপীড়নের ঘটনা ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ। এ ছাড়া অপহরণ বা জিম্মি ৫ দশমিক ৭ শতাংশ, সংঘর্ষ ২ শতাংশ, মারামারি শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ, দল বেঁধে সহিংসতা (মব ভায়োলেন্স) শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ, সম্পদের ক্ষতিসাধন শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ রয়েছে। উন্নত দেশগুলোর তরুণ জনগোষ্ঠীর অপরাধচিত্রে দেখা যায়, সেখানে প্রধানত ভাঙচুর বা সম্পত্তির ক্ষতি করার জন্য কিশোর–তরুণেরা গ্রেপ্তার হয়ে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশে এটা খুব কম।
২০২১ সালে বাংলাদেশে তরুণদের সহিংস ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২ হাজার ১৬৪ জনকে। এ ছাড়া নিহত ১ হাজার ৯৭, আহত ১ হাজার ৫৯৩, যৌন নিপীড়ন ৭৩০ এবং অপহরণের ১৩৬টি ঘটনা ঘটেছে।
কী কারণে যুবকেরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন, তা বের করার চেষ্টা করেছে বিপিও। তারা বলছে, যুবকদের মধ্যে যৌন নিপীড়ন করার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। যৌনতাসংক্রান্ত নীরব দৃষ্টিভঙ্গি যুবসমাজকে এ ধরনের অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ ছাড়া ফৌজদারি অপরাধ সম্পর্কে বোঝা বা জানার অভাবও অন্যতম কারণ।
তরুণদের সহিংসতার শিকার সবচেয়ে বেশি হয় মেয়েরা। প্রতিবেদনে তরুণদের আত্মহত্যার বিষয়টিও তুলে ধরেছে বিপিও। এতে বলা হয়েছে, ২০১৯–২০২১ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৩৩৯টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে, যার বেশির ভাগ তরুণী।
তরুণেরা নিজেরাও অনেক বেশি সংখ্যায় সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন। গত তিন বছরে ১ হাজার ৫১৩টি ঘটনার শিকার হয়েছেন তাঁরা।
তরুণদের সহিংসতার শিকার সবচেয়ে বেশি হয় মেয়েরা। প্রতিবেদনে তরুণদের আত্মহত্যার বিষয়টিও তুলে ধরেছে বিপিও। এতে বলা হয়েছে, ২০১৯-২০২১ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৩৩৯টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে, যার বেশির ভাগ তরুণী।
বিপিও বলছে, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান সাক্ষরতার হারের তুলনায় শ্রমশক্তিতে তরুণদের অংশগ্রহণ সন্তোষজনক নয়। বেকারত্বও বাড়ছে। শিক্ষিত ও দক্ষ যুবক যাঁরা অর্থনৈতিকভাবে এবং সম্ভাব্যভাবে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারছেন না, তাঁরা অনেক সময় অপরাধ ও সহিংসতার জীবনের দিকে ঝুঁকছেন। পাশাপাশি অভিভাবকত্ব, মা–বাবার সম্পর্কও সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া বাংলাদেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধিও যুব সহিংসতার ক্রমবর্ধমান প্রবণতার পেছনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ উমর ফারুকও মনে করেন, মোট জনগোষ্ঠীর তুলনায় তরুণদের সংখ্যা বেশি। ফলে অপরাধের জায়গা থেকেও সে সংখ্যা বাড়ার ঝুঁকি থাকে। তরুণদের অপরাধমুখী হওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, তরুণদের এই বয়সটা হচ্ছে উপভোগের সময়। একটি সমাজে যখন সুস্থ বিনোদন না থাকে, তখন তরুণেরা অপসংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও তরুণদের অপরাধমুখী করছে উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, এখন খুব সহজে তরুণেরা যোগাযোগ করতে পারছেন, খোঁজখবর জানতে পারছেন। এতে কারও প্রতি কারও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হলে সেখানে সহিংস মনোভাবের প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। আত্মহত্যাও বাড়তে পারে। তিনি আরও বলেন, তরুণদের মধ্যে ধর্ষণ ও মাদকসংক্রান্ত অপরাধের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে।
মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, পরিবার ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মানবিক ও মূল্যবোধ শেখানোর ঘাটতি রয়েছে। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সমাজ পরিচালিত হচ্ছে, তাতে পরিবারকে সন্তানের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে। সনদনির্ভর শিক্ষা নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল যে ভূমিকা থাকা উচিত, তা দেখা যাচ্ছে না। সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আগের মতো ভূমিকা রাখতে পারছে না।