তরুণ উদ্যোক্তা তৈরির কারিগরের হাতে উঠল ইউনেসকো-বঙ্গবন্ধু পুরস্কার

ইউনেসকো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ইন দ্য ফিল্ড অব ক্রিয়েটিভ ইকোনমি ২০২১ প্রদান অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পুরস্কার বিজয়ী প্রতিষ্ঠান মোটিভ ক্রিয়েশনসের প্রতিষ্ঠাতা জাফেথ কাওয়ানগুজি, ইউনেসকোর মহাপরিচালক অড্রে আজুলে এবং বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। ১১ নভেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে
ছবি: সংগৃহীত

আফ্রিকার দেশ উগান্ডার সৃজনশীল অর্থনীতি খাতের প্রতিষ্ঠান মোটিভ ক্রিয়েশনস লিমিটেডের উদ্যোক্তারা পেলেন ইউনেসকো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ইন দ্য ফিল্ড অব ক্রিয়েটিভ ইকোনমি। তরুণ উদ্যোক্তাদের সহায়তাকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যতিক্রমী উদ্যোগকে স্বীকৃতি দেওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে এ বছরই এই পুরস্কার প্রথম দেওয়া হলো।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সফরকালে ১১ নভেম্বর এই পুরস্কার দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা ও ইউনেসকোর মহাপরিচালক অড্রে আজুলের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী মোটিভ ক্রিয়েশনসের প্রতিষ্ঠাতা জাফেথ কাওয়ানগুজির হাতে পুরস্কার তুলে দেন।

পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন তালিকায় বিভিন্ন দেশের সৃজনশীল অর্থনীতি খাতের ৬৯টি উদ্যোগের নাম এসেছিল। তাঁর মধ্যে আফ্রিকার সৃজনশীল তরুণ উদ্যোক্তাদের সহায়তায় একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করা মোটিভ ক্রিয়েশনসকে বেছে নেন বিচারকমণ্ডলীর সদস্যরা।

পুরস্কার জয়ের প্রতিক্রিয়ায় মোটিভ ক্রিয়েশনসের প্রতিষ্ঠাতা ও দলনেতা জাফেথ কাওয়ানগুজি বলেন, এটা শুধু মোটিভ ক্রিয়েশনসের নয়, বরং পুরো সৃজনশীল সমাজের অর্জন। তিনি বলেন, উগান্ডার সৃজনশীল খাতে মেধাবী নকশাকার, শিল্পী ও তরুণ উদ্যোক্তারা সম্পৃক্ত রয়েছেন। তাঁরা নিজেদের সৃজনশীল উদ্যোগের বিকাশে সুযোগ ও প্ল্যাটফর্ম খুঁজে থাকেন। এসব পেলে তাঁরা তাঁদের উদ্যোগকে টেকসই ব্যবসায় রূপ দিতে পারবেন। মোটিভ ক্রিয়েশনস এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করে থাকে।

গত বছরের এপ্রিলে উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় যাত্রা শুরু করে মোটিভ ক্রিয়েশনস। প্রতিষ্ঠানটি উদ্যোক্তা, নকশাকার ও ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও উদ্যোগের বিকাশে সার্বিক সহায়তা দিয়ে থাকে। তাঁদের সৃজনশীল পণ্য ও সেবা বিপণনে সহায়তা করে। এর মধ্য দিয়ে আফ্রিকান তরুণ-তরুণীরা তাঁদের সৃজনশীল উদ্যোগের বিকাশ ত্বরান্বিত করতে পারছেন। শিক্ষার্থীদের জন্যও রয়েছে মোটিভ ক্রিয়েশনসের সৃজনশীল প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রতিটি প্রশিক্ষণ ও উদ্যোগে ৭০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে।
মোটিভ ক্রিয়েশনসের নিজস্ব সৃজনশীল ল্যাব, ডিজাইন একাডেমি, সৃজনশীল পণ্য ও সেবার বিপণনকেন্দ্র এবং অনলাইন মার্কেটপ্লেস রয়েছে। এসব গবেষণাগার ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রে তরুণ শিল্পীরা সৃজনশীল কাজের অনুশীলন করেন। নকশাকারেরা সৃজনশীলতা বিকাশে প্রশিক্ষণ নেন। উদ্যোক্তারা সৃজনশীল ও ঐতিহ্যবাহী পণ্যের বেচাকেনা করে থাকেন। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ সালের মধ্যে ৩ লাখ সৃজনশীল উদ্যোক্তাকে নিয়ে বৃহত্তম একটি নেটওয়ার্ক গড়তে চায়। উগান্ডার সংবাদ ম্যাগাজিন ‘দ্য ইনডিপেনডেন্ট’ তাদের প্রতিবেদনে মোটিভ ক্রিয়েশনসকে পূর্ব আফ্রিকার সবচেয়ে বড় ক্রিয়েটিভ মেকারস্পেস বা সৃজনশীল উদ্যোক্তা গড়ার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে উল্লেখ করেছে।

নিজেদের ওয়েবসাইটে মোটিভ ক্রিয়েশনস বলেছে, উগান্ডায় যাত্রা শুরু হলেও মোটিভ ক্রিয়েশনস আফ্রিকাজুড়ে সৃজনশীল অর্থনীতির সুযোগ ও সম্ভাবনার বিকাশে কাজ করছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে এই খাতের সৃজনশীল পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি ও টেকসই বিপণনে ভূমিকা রাখছে। এজন্য তরুণ উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, সার্বিক সহায়তা প্রদান এবং নেটওয়ার্ক গড়তে সহায়তা করে থাকে তারা।

মোটাদাগে নিজস্ব ওয়েবসাইটে চারটি উদ্দেশ্যের কথা বলেছে মোটিভ ক্রিয়েশনস। সেগুলো হলো—তরুণ ও সৃজনশীল উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, উদ্যোগের বিকাশে সহায়তা দেওয়া, সৃজনশীল পণ্যসেবার বিপণনে মার্কেট প্লেস হিসেবে কাজ করা এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে সৃজনশীল কমিউনিটি গড়ে তোলা। মূলত এসব কারণে পুরস্কারের জন্য নাম জমা পড়া অন্যান্য ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান থেকে এক ধাপ এগিয়ে থাকে মোটিভ ক্রিয়েশনস।

মোটিভ ক্রিয়েশনসের প্রতিষ্ঠাতা ও দলনেতা জাফেথ কাওয়ানগুজি যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিজনেস স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। জাফেথ উগান্ডায় তরুণ ও সৃজনশীল উদ্যোক্তাদের জন্য ‘ইনোভেশন ভিলেজ কাম্পালা’ গড়ে তুলেছেন। তাঁকে উগান্ডার অন্যতম তরুণ উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সংগঠক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
জাফেথ কাওয়ানগুজি বলেন, সৃজনশীল উদ্যোগের উন্নয়নে সহায়তা করাই তাদের লক্ষ্য। এর মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছেন তাঁরা।
মোটিভ ক্রিয়েশনসের ক্রিয়েটিভ বিজনেস একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন প্রিমাহ এলিজাবেথ বিরুঙ্গি। এখন তিনি উগান্ডায় একটি কমিউনিকেশন অ্যান্ড স্পিচ থেরাপির প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। প্রিমাহ এলিজাবেথ বলেন, উগান্ডার সৃজনশীল খাতের জন্য এই পুরস্কার একটি বড় অর্জন।

পুরস্কারের আদ্যোপান্ত

জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর নির্বাহী পরিষদের ২১০তম সভা অনুষ্ঠিত হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। ওই অধিবেশনে সংস্থাটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা ও অর্থায়নে আন্তর্জাতিক এই পুরস্কার চালু করা হয়েছে। পুরস্কারের অর্থমূল্য ৫০ হাজার ডলার। প্রতি দুই বছর পরপর এই পুরস্কার দেওয়ার কথা রয়েছে।

বিশ্বজুড়ে যেসব ব্যক্তি, সংস্থা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সৃজনশীল অর্থনীতির বিকাশে নানান কাজ করছে এবং এই খাতে তরুণ উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখছে, মূলত তাদের জন্যই ইউনেসকো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ইন দ্য ফিল্ড অব ক্রিয়েটিভ ইকোনমি পুরস্কার।

ইউনেসকোর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, করোনা মহামারি শুরুর আগে বৈশ্বিক সৃজনশীল খাতে সম্মিলিত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। রপ্তানি হয় ২৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি সৃজনশীল পণ্য ও সেবা। অন্যান্য খাতের তুলনায় সৃজনশীল অর্থনীতি সবচেয়ে বেশিসংখ্যক (প্রায় তিন কোটি) তরুণ–তরুণীর কর্মসংস্থান জুগিয়েছে। যাঁদের বেশিরভাগের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। ব্যতিক্রম নয় উগান্ডা। দেশটিতে সৃজনশীল অর্থনীতি খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণ–তরুণীর সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি।

করোনা মহামারি বিশ্বজুড়ে সৃজনশীল অর্থনীতিকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। ইউনেসকোর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, করোনা–পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার বৈশ্বিক সৃজনশীল অর্থনীতির গুরুত্ব ও সম্ভাবনা, দুটিকেই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে চায়। বৈশ্বিক পর্যায়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সৃজনশীল অর্থনীতির ভূমিকাকে সন্মান জানাতেই আন্তর্জাতিক এই পুরস্কার চালু করা হয়েছে।
সৃজনশীল অর্থনীতি তরুণ উদ্যোক্তাদের ছোট–বড় উদ্যোগের পৃষ্ঠপোষকতা করার মধ্য দিয়ে সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ, মানবসম্পদ ও সামাজিক উদ্যোগের উন্নয়ন এবং সর্বোপরি দারিদ্র৵ দূরীকরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে বলে ইউনেসকোর ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে। কাজেই বঙ্গবন্ধুর নামে চালু করা এই পুরস্কার সৃজনশীল অর্থনীতিতে কর্মসূচি প্রণয়ণ ও সহায়তায় সক্রিয় ভূমিকা রাখা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহ জোগাবে।

জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০২১ সালে উদ্‌যাপন করা হচ্ছে ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য সৃজনশীল অর্থনীতি’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক বছর। আর এই বছরের সৃজনশীল অর্থনীতির বিকাশে অবদান রাখায় আফ্রিকার একটি প্রতিষ্ঠানকে প্রথমবারের মতো দেওয়া হলো বঙ্গবন্ধুর নামে চালু করা আন্তর্জাতিক এ পুরস্কারটি।
ইউনেসকো ও মোটিভ ক্রিয়েশনসের ওয়েবসাইট এবং ‘দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট’ অবলম্বনে লিখেছেন অনিন্দ্য সাইমুম ইমন