তারেকের সাত বছর জেল

.
.
মোট মামলা ১৩০
* ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দুটি মামলা: বিচার চলছে
* জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা: সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে
* হুমায়ুন কবির সাব্বির হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে ২১ কোটি টাকা ঘুষের মামলা: মামলা বিচারাধীন
* ১০০টি মামলা ঢাকার বাইরে বিভিন্ন আদালতে। এর প্রায় সবই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি ও মানহানির অভিযোগে

বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করলেও ওই অপরাধে তারেক রহমানের যুক্ত থাকার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা যায়নি বলে মনে করেছিলেন বিচারিক আদালত। সেই বিচার পর্যালোচনা করে প্রায় আড়াই বছর পর উচ্চ আদালত গতকাল বললেন, তারেক রহমান ‘সচেতনভাবে এই আর্থিক অপরাধের অংশ ছিলেন। তাই তিনি কোনো ধরনের ছাড় পেতে পারেন না।’

মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় বিচারিক আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিলেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে তাঁকে ২০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সাত বছরের কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। তবে বিচারিক আদালতে মামুনকে দেওয়া ৪০ কোটি টাকার জরিমানা কমিয়ে ২০ কোটি টাকা করা হয়েছে।

বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আপিল মঞ্জুর ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের আপিল খারিজ করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘দুঃখের সঙ্গে দেখা যায়, তারেক রহমান এমন একটি রাজনৈতিক শ্রেণির সদস্য, যাঁদের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে দিকনির্দেশনা দেওয়া, অথচ তিনি সচেতনভাবে একটি আর্থিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। তিনি তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে পরামর্শ মাশুলের নামে নোংরা অর্থ অর্জন করেছেন। আর এতে তাঁর সহযোগী ছিলেন গিয়াসউদ্দিন আল মামুন। এই ধরনের রাজনৈতিক প্রভাবপুষ্ট দুর্নীতি দেশের সুশাসন, টেকসই উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য হুমকি।’

রায়ে হাইকোর্ট আরও বলেন, যেহেতু তারেক রহমান এখন পলাতক, তাই তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার বা আত্মসমর্পণ করার পর দণ্ড কার্যকর হবে। এ জন্য তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারির জন্য বিচারিক আদালতকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ২০০৭ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে কারাগারে আছেন। তিনি তারেক রহমানের বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার।

২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এর বিচারক মোতাহার হোসেন তারেক রহমানকে বেকসুর খালাসের রায় দেওয়ার পর অবসরে যান। এরপর ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। তিনি আর দেশে ফিরে আসেননি। দুদক তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

গতকাল রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট জোরালোভাবে মত প্রকাশ করে বলেন, ‘দুর্নীতি চর্চা ও রাজনৈতিক প্রভাব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে মানি লন্ডারিংয়ের মতো আর্থিক অপরাধ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। এতে গোটা সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। রাজনৈতিক ঢাল ব্যবহার করে সম্পদ অর্জনের অবৈধ পন্থা ও আর্থিক অপরাধ বেড়ে চলেছে। আদালত মনে করেন, দেশের কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় এই ধরনের অপরাধ বন্ধ করার এখন সময় এসেছে।’

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ২০০৮ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির অভিযোগে ১৩০টি মামলা রয়েছে। এই প্রথম কোনো মামলায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হলেন। এর আগে তাঁর ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকো মানি লন্ডারিংয়ের আরেকটি মামলায় দণ্ডিত হয়েছিলেন। দণ্ডিত অবস্থায় বিদেশে থাকাকালে গত বছর তিনি মারা যান।

এই মামলার বিচার করতে গিয়ে মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকায় আরও চারজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তাঁরা হলেন হোসাফ গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, নির্মাণ কনস্ট্রাকশনের চেয়ারম্যান খাদিজা ইসলাম এবং দুই বিদেশি মায়ের সাইরি ও মেরিনা জামান। রায়ে বলা হয়, তাঁরাও এই মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়ার অংশ ছিলেন এবং পাচার করা অর্থ পেতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করেছিলেন।

প্রতিক্রিয়া: রায়ের পর তারেক রহমানের অন্যতম আইনজীবী জয়নুল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা মনে করি, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যে রায় হয়েছে তা যথাযথভাবে হয়নি। তিনি ন্যায়বিচার পাননি।’

তারেক রহমানের আরেক আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা স্তম্ভিত, হতবাক। এ মামলায় ট্রায়াল কোর্টে দুদক প্রমাণ দিতে পারেনি যে গিয়াস উদ্দিন মামুন এক টাকাও বিদেশে নিয়েছেন। তারপরও তাঁকে সাজা দিয়েছে, তারেককে খালাস দিয়েছে।’

মাহবুব উদ্দিন আরও বলেন, আজ আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেল, দুদকের আইনজীবী ও আওয়ামী লীগের সব বড় বড় আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ও দুদকের আইনজীবীরা একাকার হয়ে গেছেন।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, এই রায়ে প্রমাণিত হলো, যে যত বড়ই হোক না কেন, আইন অমান্য করলে তাঁকে আইনের আওতায় আসতে হবে। তারেক-মামুন যে অপরাধ করেছেন, তা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঘটানো হয়েছে। তিনি বলেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হলে তারেক রহমানকে আগে আত্মসমর্পণ করতে হবে।

রায়ের পর দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকার নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এই রায় তারই অংশ।

ঘুষের টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার: ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর তারেক ও মামুনকে আসামি করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলাটি করে দুদক। মামলায় অভিযোগ করা হয়, টঙ্গীতে প্রস্তাবিত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ নির্মাণ কনস্ট্রাকশন্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ঘুষ নেন মামুন। ২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ওই টাকা বিভিন্ন পদ্ধতিতে সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকে মামুনের ব্যাংক হিসাবে পাচার করা হয়। ওই টাকার মধ্যে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা উত্তোলন করে খরচ করেন তারেক রহমান।

২০১১ সালের ৬ জুলাই এই মামলার বিচার শুরু হয়। রায় হয় ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর। রায়ে তারেক রহমানকে খালাস এবং গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে সাত বছর কারাদণ্ড এবং ৪০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।

পরে ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর তারেক রহমানের খালাসের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন করে দুদক। ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি হাইকোর্ট দুদকের আপিল গ্রহণ করে তারেককে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। লন্ডনপ্রবাসী তারেক না ফেরায় আদালত তাঁর বিরুদ্ধে সমন জারি করে তাঁর লন্ডনের ঠিকানায় পাঠান। কিন্তু তাতেও তারেক রহমান সাড়া দেননি। পরে তাঁকে পলাতক ঘোষণা করেন আদালত। এরপর দুদকের করা আপিলের সঙ্গে কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে মামুনের করা আপিল একই সঙ্গে শুনানি শুরু হয়। গত ৪ মে হাইকোর্টে দুটি আপিলের একসঙ্গে শুনানি শুরু হয়, শেষ হয় ১৬ জুন।