তালপাতার পাখায় দুধে-ভাতে

মেয়ে ও ছেলের স্ত্রীকে নিয়ে পাখা তৈরির কাজ করছেন হাজেরা বিবি (ডানে)। ছবিটি বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের আতালপাড়া গ্রাম থেকে সম্প্রতি তোলা l ছবি: প্রথম আলো
মেয়ে ও ছেলের স্ত্রীকে নিয়ে পাখা তৈরির কাজ করছেন হাজেরা বিবি (ডানে)। ছবিটি বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের আতালপাড়া গ্রাম থেকে সম্প্রতি তোলা l ছবি: প্রথম আলো

এই গরমে তালপাতার পাখার বাতাসে গা জুড়িয়ে যায়। যাঁদের বৈদ্যুতিক পাখার সুবিধা নেই, তাঁদের কাছে তালপাতার পাখা আজও পরম আদরণীয়। দেশজুড়ে চৈত্রসংক্রান্তি ও পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে মেলায় রংবেরঙের পাখা বিক্রি হতে দেখা যায়। তালপাতার সব ধরনের হাতপাখা তৈরি করেন বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের তিন গ্রামের নারীরা। পুরুষেরা সংসারের হাল টানেন আর নারীরা গৃহস্থালির পাশাপাশি তালপাখা তৈরি করে সংসারের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। একসময় এই তিন গ্রামের মানুষ দিনমজুরির কাজ করে সংসার চালাতে হিমশিম খেয়েছেন। এখন পাখা তৈরি করে সন্তানসন্ততি নিয়ে দুধে-ভাতে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা।
পাখা তৈরির গ্রামে একদিন
কাহালু উপজেলা সদর থেকে ১৮-২০ কিলোমিটার উত্তরে পাইকড় ইউনিয়নের পাশাপাশি তিনটি গ্রাম। গত শুক্রবার সরেজমিনে দেখা গেল, একেক গ্রামে একেক ধরনের পাখা তৈরির কাজ চলছে। আতালপাড়া গ্রামে ঘোরানো পাখা, যোগিরভবন গ্রামে হাতল পাখা আর আড়োলা উত্তরপাড়া গ্রামে পকেট পাখা তৈরির কাজ চলছে। শীতের শেষে বসন্তকালে অর্থাৎ ফাল্গুন মাস থেকে পাখা তৈরির কাজ শুরু হয়। প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় কাঁচা তালপাতা বিছিয়ে শুকানো হচ্ছে। পুরুষেরা কাঁচা বাঁশের কাজ করছেন। আর নারীরা সুই-সুতা দিয়ে পাখা বাঁধানো ও রঙের কাজ করছেন। পাখার চাহিদা মেটাতে গরম মৌসুমে নারী-পুরুষের দম ফেলার ফুরসত নেই। চুলায় ভাত-তরকারি তুলে দিয়ে পাখা তৈরির কাজ নিয়ে বসেন তাঁরা। শিশু-কিশোরেরাও লেখাপড়া ও খেলাধুলার পাশাপাশি মা-বাবার সঙ্গে পাখার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে এ মৌসুমে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারেরা আসেন পাখা নিতে। আবার অনেকে প্রান্তিক কারিগরদের আগাম টাকা দিয়ে পাখা তৈরি করিয়ে নেন।
তালের পাতা ও তল্লাবাঁশ আমদানি
আড়োলা, আতালপাড়া, যোগিরভবন—এসব গ্রামে তালগাছ তেমন নেই, নেই বাঁশের বড় বাগানও। কিন্তু পাখা তৈরির জন্য তালের এত পাতা কিংবা তল্লাবাঁশ আসে কোথা থেকে? আতালপাড়া গ্রামের ৭৫ বয়সোর্ধ্ব লইমুদ্দিন আকন্দ জানান, রাজশাহীর কয়েকটি উপজেলা থেকে তালপাতা আনেন স্থানীয় পাইকারেরা। বগুড়া সদরের নুনগোলা ইউনিয়নের দশঠিকা, বারপুর, শিকারপুর, ঘোলাগাড়ি, আখরাইল গ্রাম থেকে আসে তল্লাবাঁশ। লইমুদ্দিন তাঁর স্ত্রী আছিয়া খাতুন ও নাতি মাহবুর রহমানকে নিয়ে ঘোরানো পাখা তৈরির কাজ করছেন। এসব গ্রামে কত দিন ধরে পাখা তৈরির কাজ হয়—জানতে চাই তাঁর কাছে। তিনি বলেন, ‘কদ্দিন থ্যাকা পাখা বানান হচ্চে, সেডা কওয়া মুশকিল বাপো। তবে হামার বাপ-মায়েরাও এই কাম করিচে। একন হামি করিচ্চি। এরপর হামার ছলেরা করবি। ইংক্যারাই পাখা বানানোর কাজ হয়্যা আসিচ্চে। হামার বাপের আমলে রাস্তা-ঘাট ভালো আচলো না। তকন তারা খ্যাটাই মরিচে আর পাইকার-ব্যবসায়ীরা মজা মারিচে। একন রাস্তা-ঘাট ভালো হইয়া হামরা সরাসরি পাইকারের কাচে পাখা বেচপার পারিচ্চি। একন দুডা ট্যাকা চোখে দেইকবার পারিচ্চি।’
দিনরাত ব্যস্ত নারীরা: ঘোরানো পাখার গ্রাম আতালপাড়ায় লইমুদ্দিনের পাশের বাড়িতে শাশুড়ি হাজেরা বিবি তাঁর ছেলের বউ শান্তনা বেগম ও মেয়ে মরিয়ম খাতুনকে নিয়ে ঘোরানো পাখায় চুঙ্গি লাগানো ও রং করার কাজ করছেন। হাজেরা বিবি জানান, ১০০ পাখা বানাতে দুই দিন সময় লাগে। একেকটি পাখায় খরচ পড়ে আট-নয় টাকা। পাইকারেরা ১০-১২ টাকা করে একেকটি পাখা কেনেন। তিনি বলেন, ‘নগদ ট্যাকা দিয়্যা মালামাল কিনা কাজ করলে পাখাপ্রতি তিন ট্যাকা কর্যায় লাভ টিকে। কিন্তু ট্যাকার অভাবে পাইকারের কাছ থ্যাকা আগাম টাকা লিয়্যা পাখা তৈরি করিচ্চি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ কয় মাস খাওয়া আর ঘুমান ছাড়া দিনরাত অর্ডারি পাখা বানাতেই যায়।’ গরমের এ মৌসুমে তাঁরা আট-দশ হাজার পাখা তৈরি করেন।
হাজেরা বিবি আরও বলেন, ‘এনজিও আশা, টিএমএসএস, গ্রামীণ ব্যাংক থিকা ট্যাকা লিচে বেশির ভাগ মহিলা। কিন্তু সপ্তাহে কিস্তি দেওয়ার জন্যি মাঝে-মধ্যে কম দামে পাখা বিক্রি করা লাগে।’ কয়েকজন নারী দাবি করেন, সরকারি ব্যাংক থেকে মৌসুমি ঋণ পেলে প্রান্তিক কারিগরের উপকার হতো।
হাতল পাখার গ্রাম: যোগিরভবন গ্রামে হাতল (ডাটা) পাখা তৈরির কাজ চলছে। এ গ্রামে পাইকারি মহাজন তিনজন। তাঁরা হলেন আবদুল লতিফ, আবুল কাশেম ও ইউসুফ আলী। তাঁরা পরিবারের নারী সদস্যদের নিয়ে হাতল পাখা তৈরির কাজ করছেন। আবার গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে পাখা তৈরির মালামাল জোগান দিয়ে, পাখাপ্রতি দুই টাকা পারিশ্রমিক দিয়ে পাখা বানিয়ে নেন। আবদুল লতিফ জানান, হাতল পাখার জন্য রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ডাটাসহ তালের পাতা কেনেন তাঁরা। ওই সব এলাকার পাইকারেরা প্রতি শয়ে ৫০০ টাকা করে নিয়ে গ্রামে পৌঁছে দেন। সুতা ও রং ব্যবহার করে তাঁরা প্রতি শয়ে ১ হাজার ৩০০ টাকা করে বিক্রি করেন বিভিন্ন জেলার পাইকারদের কাছে। একেকটি পাখায় আড়াই-তিন টাকা লাভ টেকে। তিনি জানালেন, গোটা মৌসুমে ২০-২৫ হাজার পাখা তৈরি করান তিনি।
পকেট পাখার গ্রাম: আড়োলা উত্তরপাড়ার কারিগরেরা পকেট পাখা তৈরি করেন। এ গ্রামের শতাধিক পরিবারের লোকজন এ কাজ করেন। এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি বাড়িতেই পকেট পাখা তৈরির কাজ চলছে। পকেট পাখার কারিগর আকরাম হোসেন বাড়ির বারান্দায় পাখা বাঁধছেন আর তাঁর স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম রঙের কাজ করছেন। আকরাম হোসেন জানান, শুধু তালের পাতা প্রতি শ ৫০০ টাকায় কিনতে হয়। এর সঙ্গে কাঁটা (পেরেক), সুতা ও রঙের খরচ পড়ে প্রতি শতে ৩০০ টাকা। তিনি বলেন, ‘ডাটা পাখা ও ঘুরনি পাখার চেয়ে পকেট পাখা তৈরির ঝামেলা বেশি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সারা দেশে ক্যারেন্টের লাইন হইয়া চাহিদা কমার কথা, কিন্তু দিন দিন এর চাহিদা তো ব্যাড়াই যাইচ্চে।’
পাইকড় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন জানালেন, এই তিন গ্রামের পাঁচ শর বেশি পরিবার পাখা তৈরির কাজ করেন। তবে এ ইউনিয়নে কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে নারীদের ঋণ দিলে আরও উপকার হতো। অনেক বাড়ির লোকজন দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে চড়া মুনাফা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।