
‘সবে বেলা পড়ে এসেছে। খেত থেকে ঘরে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। মংডুর টংবাজার গ্রামে হঠাৎ গুলির শব্দ আর আগুন। লোকজন পালাচ্ছে আর বলছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ব্রাশফায়ার করছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তাকিয়ে দেখি, শত শত মানুষ শুধুই দৌড়াচ্ছে। আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম পালিয়ে যাব। একটু দূরে যেতেই শুনি একটি শিশুর কান্নার আওয়াজ। আশপাশে তখন কেউ নেই। আমার স্ত্রী বললেন, “এত ছোট বাচ্চাকে ফেলে যাব কী করে? চলো নিয়ে যাই।” কোলে নিলাম। বাংলাদেশে আসার পরে ক্যাম্পের এক কর্মী বললেন, ওর নাম রাখেন রাবেয়া। এটা এক তাপসী নারীর নাম।’
কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী-২ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে ১২ সেপ্টেম্বর নিজ গ্রামে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তাণ্ডবের কথা বলছিলেন এলম বাহার। চোখ মুছে বললেন, এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য সরকার নাকি পুনর্বাসন কেন্দ্র করছে। কিন্তু রাবেয়াকে তিনি সেখানে পাঠাবেন না। নিজের দুই সন্তানের সঙ্গে তাকেও বড় করবেন। এলম বাহারের পাশে দাঁড়ানো স্ত্রীও স্বামীর কথায় সায় দিলেন।
রাবেয়ার আপাতত একটা ঠিকানা হলেও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তাণ্ডবের সময় মা-বাবা হারানো অনেক শিশু এখনো ঠিকানাবিহীন। কোনো পরিবারের সঙ্গে যুক্ত নয় বলে ক্যাম্পের তালিকায় তাদের নাম নেই। এরা কোনো ত্রাণও পায় না।
কক্সবাজার জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক প্রীতম কুমার চৌধুরী জানালেন, ঠিকানাবিহীন এসব শিশুর তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছেন তাঁরা। এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ৭৬৬ জনকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তবে এ সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে তিনি ধারণা করেন।
গত ৮ দিনে বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে এমন অনেক শিশুর কথা জানিয়েছেন ক্যাম্পের বাসিন্দারা। তাদের মধ্যে গতকাল শনিবার বালুখালী-১ শিবিবে কথা হয় ৭ এতিম শিশুর সঙ্গে। এদের বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। কোথায় আছেন তা-ও জানা নেই। মা-বাবার কথা বললেই এসব শিশুর চোখ ছলছল করে ওঠে।
বালুখালী ক্যাম্পের কাদাপানিতে খেলা করছে জয়নাব। তার দিকে তাকালে মন খারাপ হয়ে যায়। এ ব্লকের ৬ নম্বর শেডে আবুল ফয়েজের সঙ্গে থাকছে জয়নাব। ওদের বাড়ি রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের পাশের গ্রাম সাতগড়িয়াপাড়ায়। জয়নাব বলল, সেনাবাহিনীর সদস্যরা এক রাতে ওর বাবা মো. ছাদেক ও মা দিলদারা বেগমকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ও তখন ঘুমাচ্ছিল। সকালে উঠে জানতে পারে, মা-বাবার লাশ নাফ নদীতে ফেলে দিয়েছে সেনাবাহিনী।
আট বছরের জয়নাব চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে, ‘বাপ-মার লাই আঁর মন জ্বলের। বাপ-মা ছাড়া আই কেনে বাইচ্চুম।’ জয়নাব জানাল, সকালে দেখে, সব লোক পালাচ্ছে। সেও তাদের সঙ্গে চলে আসে।
আসমা বেগমের বয়সও আট বছর। বাড়ি রাখাইন রাজ্যের নাইছাপ্রু গ্রামে। আসমা জানাল, এক রাতে সেনাবাহিনী তার বাবা আলী জোহারকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। প্রতিবাদ করায় তার চোখের সামনে মা হামিদা খাতুনকেও হত্যা করে। মা-বাবার লাশ ধানখেতে পুঁতে ফেলে। সকালে এক প্রতিবেশী নানির সঙ্গে পালিয়ে আসে সে। নানি মকসুদা খাতুন বলেন, আসমা সারাক্ষণ মা-বাবার জন্য কান্নাকাটি করে।
এদের মধ্যে বড় জহুরা। ওর বয়স ১৪। বাড়ি রাখাইন রাজ্যের কাজিরবিল গ্রামে। জহুরা জানাল, গত মাসের ২০ তারিখ সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী ঘরে ঢুকে তার বাবা মো. রশিদকে গুলি করে। তারপর মা হাসিনা খাতুনকে ধানখেতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। সেদিন জহুরা পালিয়ে পাশের গ্রামে আশ্রয় নেয়। তিন দিন পর এক প্রতিবেশীর সঙ্গে পালিয়ে আসে।
বালুখালী অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের মাঝি (দলনেতা) জাকের হোসেন বলেন, এই শিবিরে দেড় লাখের মতো রোহিঙ্গা বসতি আছে। তাদের মধ্যে পাঁচ হাজারের মতো শিশু, যাদের মা-বাবা, ভাইকে গুলি বা জবাই করে হত্যা করা হয়েছে।
জাকির হোসেন জানান, অপ্রাপ্ত বয়স্ক এসব শিশু কোনো পরিবারের সঙ্গেই যুক্ত নয়। এ কারণে তাদের কোনো ত্রাণ কার্ড ও বায়োমেট্রিক কার্ড নেই। যে এতিম শিশু যে ব্লকে থাকে, সেই ব্লকের লোকজন যে ত্রাণ পান, সেটাই ওই সব শিশুকে ভাগ করে দেন।
প্রথম আলোর টেকনাফ প্রতিনিধি গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে এতিম শিশু মো. জাকেরের। সে জানায়, বাবা মো. ইউনুচ ও মা আনোয়ারা বেগম মংডুর গজরবিলের বাসিন্দা ছিলেন। গত ২৫ আগস্ট সকালে গ্রামে ২৭ জনকে সেনারা ধরে নিয়ে যায়। এরপর তার বাবা আর ফিরে আসেননি। পরদিন লাশ ফেলে দিয়ে যায় সেনারা।
আরেকজন আনোয়ার সাদেকের বয়স ৭ বছর। বাবা মুসা আলী, মা নুর খাতুন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য দংখালী গ্রামে বসবাস। তাদের গ্রামে হামলা চালায় সেনাবাহিনী। সেখান থেকে পালিয়ে আসে সাদেক। বাবা-মা কোথায় আছে কিছুই জানে না।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গার মধ্যে ৫৩ শতাংশ নারী ও শিশু। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের হিসাবে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন সাড়ে পাঁচ লাখ। এই হিসাবে নারী ও শিশুর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৯১ হাজার ৫০০। এদের মধ্যে পাঁচ বছরের নিচে শিশুর সংখ্যা ২৯ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৯ হাজার ৫০০। শিশুদের মধ্যে ৮২ হাজারই মেয়েশিশু। আইওএম বলেছে, অভিভাবকহীন দেড় হাজার শিশুকে তারা প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছে। তবে এ সংখ্যা বাড়বে বলে জানায় সংস্থাটি।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের সুরক্ষার জন্য উখিয়ার বালুখালী একটি শিশুপল্লি তৈরি করা হবে। আশ্রয় শিবির তৈরির জন্য সেখানে যে দুই হাজার একর জমি বরাদ্দ করা হয়েছে, সেখান থেকে ২০০ একর দেওয়া হবে শিশুপল্লিকে। এই পল্লি তৈরি করবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। গত ২৮ সেপ্টেম্বর সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এই স্থান পরিদর্শন করেন।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের শনাক্তের পর তাদের তথ্য নিবন্ধন করা হচ্ছে। নিবন্ধিত শিশুরা স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে সব ধরনের সহযোগিতা পাবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি সংস্থার এক কর্মী জানালেন, এসব শিশু দিনে দিনে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাদের অনেকে অস্বাভাবিক আচরণও করছে। ক্যাম্প থেকে এদের দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া দরকার।