তিন চিকিৎসক দিয়ে চলছে হাসপাতাল
প্রতি ওয়ার্ডের বেডভর্তি রোগী। রোগী আসছে-যাচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসক নেই; আছেন কিছু নার্স, তাঁরাই রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছেন। গত ১৮ জানুয়ারি বুধবার বেলা দুইটার দিকে জরুরি বিভাগেও কেউ ছিলেন না। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বরিশালে সভায় গিয়ে ওই দিন আসেননি। অন্যদের কক্ষেও তালা মারা। এ রকম চিত্র ভোলার লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লালমোহন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ২২টি পদ থাকলেও কাজ করছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ মাত্র দুজন। এর একজন ডেন্টাল সার্জন ও অন্যজন চিকিৎসা কর্মকর্তা। সম্প্রতি লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে অর্থোপেডিক চিকিৎসক মহিবুর রহমানকে প্রেষণে আনা হয়েছে। নার্সের পদ আছে ১৪টি। এই পদে কাজ করছেন ১২ জন। দুটি নার্সিং সুপার ভাইজারের পদ শূন্য। জরুরি প্রসূতিসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও অবেদনবিদের পদটি শূন্য থাকায় অস্ত্রোপচার বন্ধ রয়েছে। সাধারণ পরীক্ষার জন্য টেকনোলজিস্ট-রেডিওলজিস্ট নেই, তাই এক্স-রে কক্ষেও তালা। রোগীরা সাধারণ ওষুধও পাচ্ছেন না। ওষুধ কিনতে হয় বাইরে থেকে।
উপজেলার লোকসংখ্যা প্রায় সাত লাখ। তাদের জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, ৯টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র এবং ২৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। সর্বত্রই জনবলের চরম সংকট চলছে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওষুধ না থাকার বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত করেছেন লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার সরদার। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে সামান্য কিছু ওষুধ আছে। তবে সব রকম ওষুধ নেই।’ তিনি বলেন, লালমোহনের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অনেক কিছুই নেই। হাসপাতালের সমস্যা নিয়ে তিনি একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। বিশেষ করে চিকিৎসক-সংকটের বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বড় কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন।
জরুরি কোনো রোগী এলে কী করে সামাল দেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সন্তোষ কুমার সরদার বলেন, জরুরি রোগীকে সেবা দেওয়ার কোনো সুবিধাই এখানে নেই। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর ভোলা সদর বা বরিশাল পাঠাতে হয়।
ওষুধসংকট ও চিকিৎসকের পদ শূন্য থাকার কারণ হিসেবে জেলা সিভিল সার্জন রথীন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, ওষুধের সংকট নেই, হয়তো লালমোহনে অতিরিক্ত রোগী থাকায় সংকট হতে পারে, জেলা সদর থেকে ওষুধ হয়তো নিচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চিকিৎসকের শূন্য পদ পূরণ করার চেষ্টা করছি।’
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগী নিয়ে আসা লালমোহন পৌর শহরের বাসিন্দা শাহিন পাটওয়ারী বলেন, ‘এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি উপজেলার মানুষের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার প্রধান ভরসা। কিন্তু এখানের জরুরি বিভাগেরই জরুরি অবস্থা। চিকিৎসক তো দূরের কথা, দক্ষ নার্সও নেই।’
১৮ জানুয়ারি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাইরে ওষুধের দোকানে কয়েকজন রোগীর অভিভাবককে ওষুধ কিনতে দেখা যায়। সেখানে ও শহরে কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। হাসপাতালের সিটিজেন চার্টারে সরবরাহ করা ৮২ পদের ওষুধের নাম উল্লেখ আছে।
পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা লালমোহন পৌরসভার করিম রোডের বাসিন্দা মো. নাজিম হাওলাদার বলেন, জ্বর ও ব্যথার জন্য তিনি দুই দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তাঁকে প্রায় সব ওষুধই বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে বলে তিনি জানান। অন্তর্বিভাগে ভর্তি হওয়া আরও কয়েকজন রোগী একই অভিযোগ করেছেন।
লালমোহন ইউনিয়নের কিশোরগঞ্জ এলাকার মো. শাকিল (৩৪) বলেন, ‘এই হাসপাতালে কোনো ডাক্তার নাই, নার্স আপারাই বড় ডাক্তার।’ একই মন্তব্য শতাধিক রোগী ও অভিভাবকের।
৫০ শয্যার এই হাসপাতালে ১৮ জানুয়ারি ভর্তি ছিল প্রায় ৬৫ জন। ওই দিন ভর্তি হয়েছে ২৩ জন। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ১০৬ জন।
উপজেলার নাজিরপুরের মো. ফিরোজ বলেন, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক থাকলেও তাঁরা ঠিকমতো কর্তব্য পালন করছেন না। কারণে-অকারণে তাঁরা ঢাকা-বরিশাল যাচ্ছেন।’
লালমোহন পৌরসভার মেয়র ইমদাদুল ইসলাম পঞ্চায়েত বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসক না থাকায় বেসরকারি ভুয়া ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালেরা রোগী নিয়ে কাড়াকাড়ি করছেন। কিন্তু ক্লিনিকেও চিকিৎসক নেই। ফলে তারা ভুয়া চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছে।