চট্টগ্রাম নগরের ৪১টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে একটি করে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপনের জন্য তিন বছর আগে উদ্যোগ নেয় সিটি করপোরেশন। প্রতি ওয়ার্ডের জন্য দুজন করে মোট ৮২ জন উদ্যোক্তাও নির্বাচন করে করপোরেশন। কিন্তু এত দিনে মাত্র ৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ড ছাড়া আর কোথাও ডিজিটাল সেন্টার চালু করা সম্ভব হয়নি।
তিন বছরেও ডিজিটাল সেন্টার চালু না হওয়ায় হতাশা থেকে বেশির ভাগ উদ্যোক্তা অন্য পেশা বা ব্যবসায় যুক্ত হন। বাধ্য হয়ে করপোরেশন আবারও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে উদ্যোক্তা বাছাই করে। কিন্তু তিন মাস ধরে তাঁরাও অলস বসে আছেন। প্রতিটি সেন্টারে একজন পুরুষের পাশাপাশি একজন নারী উদ্যোক্তা নির্বাচন করার বিধান থাকলেও প্রথম দফায় পাওয়া যায় মাত্র ১৫ জন, দ্বিতীয় দফায় পাওয়া যায় ২৪ জন।
সর্বশেষ গত ১৬ মার্চ ডিজিটাল সেন্টার স্থাপনের তাগাদা দিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে সিটি করপোরেশনকে চিঠি পাঠানো হয়। এতে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সব ওয়ার্ডে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপনের কাজ শেষ করতে বলা হয়। কিন্তু বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে ৪০টি ওয়ার্ডেই ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করতে পারেনি সিটি করপোরেশন।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ড কার্যালয়ের একটি কক্ষ ডিজিটাল সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এসব কক্ষে বসে অর্থের বিনিময়ে নাগরিকদের বিভিন্ন সেবা দেবেন উদ্যোক্তারা।
সরকারের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের আওতায় ২০১০ সালের নভেম্বরে ইউনিয়ন পর্যায়ে তথ্যসেবা কেন্দ্র চালু করা হয়। এরপর দেশের প্রতিটি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় ডিজিটাল সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এসব সেন্টার চালুর উদ্দেশ্য হচ্ছে ওয়ার্ড কার্যালয়ে সেবা নিতে আসা নাগরিকেরা যাতে এক জায়গা থেকেই সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের তথ্য ও অনলাইনসেবা (জন্মসনদ, নাগরিকত্ব সনদ তৈরি, পাসপোর্টের ফরম পূরণ করা, ফটোকপি করা, কম্পিউটার প্রিন্ট করা, বিভিন্ন ফরম ডাউনলোড করে দেওয়া) পেতে পারেন। সেন্টারগুলো যাঁরা পরিচালনা করবেন, তাঁদের পরিচয় হবে ‘উদ্যোক্তা’। তাঁরা সরকার বা সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে বেতন পাবেন না। সেবার ধরন অনুযায়ী নাগরিকদের কাছ থেকে অর্থ নেবেন তাঁরা।
ডিজিটাল সেন্টার চালু করতে দেরি হওয়ার বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ শফিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সব কাউন্সিলর নিজেদের কার্যালয়ে কক্ষ বরাদ্দ দিতে নীতিগতভাবে একমত। তবে অবকাঠামোগত কিছু অসুবিধার জন্য এখনো ডিজিটাল সেন্টারের কাজ শুরু করা যায়নি। শিগগিরই ডিজিটাল সেন্টারগুলো চালু হবে।
হতাশায় ঝরে গেছেন পুরোনো উদ্যোক্তারা: ২০১৩ সালের এপ্রিলে নগরের ৪১টি ওয়ার্ড থেকে দুজন করে উদ্যোক্তা নির্বাচন করেন ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। প্রথম দফায় মাত্র ১৫টি ওয়ার্ডে নারী উদ্যোক্তা নির্বাচন করা সম্ভব হয়। বাকি ৬৭ জন ছিলেন পুরুষ উদ্যোক্তা। কিন্তু তিন বছরেও কাজ শুরু করতে না পারায় হতাশ হয়ে উদ্যোক্তাদের অনেকেই অন্য পেশায় চলে যান বা নিজের মতো করে কাজ শুরু করেন।
উদ্যোক্তাদের নতুন করে নিয়োগ দিতে এ বছরের ২৯ জানুয়ারি স্থানীয় কয়েকটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয় সিটি করপোরেশন। কিন্তু এবারও নারী উদ্যোক্তা পাওয়া গেছে মাত্র ২৪টি ওয়ার্ডে। দ্বিতীয় দফার নিয়োগে পুরোনো উদ্যোক্তার মধ্যে মাত্র ১০ জন পুরুষ ও চারজন নারী রয়েছেন। বাকি ৫১ জনই নতুন।
প্রথম দফায় লালখান বাজার ওয়ার্ডের জন্য উদ্যোক্তা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন খোকন ধর। দ্বিতীয় দফায় তিনি আর উদ্যোক্তা হতে আগ্রহ দেখাননি। তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রায় এক বছর অপেক্ষা করেছি, কিন্তু কাজ শুরু করতে পারিনি। এখন অন্য ব্যবসা করছি।’
দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ডে নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছেন জিয়াউর রহমান। তিনি বলেন, ‘কত দিন অপেক্ষা করতে হবে বুঝতে পারছি না। বেশি দেরি হলে বিকল্প কাজের চিন্তা করতে হবে।’
তবে পুরোনো ১৪ উদ্যোক্তার একজন মো. ইব্রাহিম খলিল। তিনি বলেন, ‘মেয়র আশ্বস্ত করেছেন, এবার দ্রুত ডিজিটাল সেন্টারগুলো চালু হবে।’
নারী উদ্যোক্তা কম: দুই দফায়ও নগরের ৪১ ওয়ার্ডে ডিজিটাল সেন্টারের জন্য ৪১ জন নারী উদ্যোক্তা পাওয়া যায়নি। পুঁজির অভাব, পরিবারের অনীহা, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিসহ নানা কারণে নারীরা উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী হচ্ছেন না। ইউনিয়নগুলোতে উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার বিনা মূল্যে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার, ফটোকপিয়ার মেশিন, ইন্টারনেট মডেমসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করে। কিন্তু নগর ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তারা এ সুবিধা পান না। তাঁদের নিজেদের বিনিয়োগ দিয়ে তথ্যসেবা কেন্দ্র চালাতে হবে।
চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৈয়দা কামরুন নেসা বলেন, পরিবার থেকে একটি ছেলে ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য সহজে টাকা পায়। কিন্তু মেয়েদের বেলায় উল্টোটা ঘটে।
সম্প্রতি বিয়ে হয়ে যাওয়া এক নারী উদ্যোক্তা জানান, স্বামী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা তাঁকে এ কাজে নিরুৎসাহিত করছেন।
চট্টগ্রাম উইমেন চেম্বারের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট গুলশানা আলী বলেন, নারীদের জন্য বিনিয়োগের অর্থ জোগাড় করাটা একটি বড় সমস্যা। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি নারীদের জন্য বিনা মূল্যে কম্পিউটারসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেয়, তা হলে নারী উদ্যোক্তাদের পাওয়া সহজ হবে।
উদ্যোক্তা হতে ২০১৩ সালে এগিয়ে এসেছিলেন রিমা চৌধুরী। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় তিনি আর আসেননি। তাঁর বক্তব্য, যথাসময়ে ডিজিটাল সেন্টার চালু না হওয়ায় তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
দ্বিতীয় দফায় উদ্যোক্তা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন সানজিদা ইয়াসমিন। একটি কম্পিউটার ও মডেম ছাড়া তাঁর আর কোনো সরঞ্জাম নেই। তিনি বলেন, ‘ফটোকপি মেশিন বা প্রিন্টারের মতো প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনার সামর্থ্য নেই আমার। যদি সরকার এসব সরবরাহ করত, তাহলে সুবিধা হতো।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সচিব আবুল হোসেন বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে বেশির ভাগ উদ্যোক্তারই কম্পিউটারসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনার সামর্থ্য নেই। সে কারণে তাঁদের সরকারের পক্ষ থেকে এসব সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু শহরের চিত্র ভিন্ন। এখানকার উদ্যোক্তারা নিজ থেকেই বিনিয়োগ করবেন। করপোরেশন তাঁদের জায়গা দেবে। তাঁদের কার্যক্রম তদারক করবে।