তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে বন্যা
![দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। বাড়ছে ঢাকার আশপাশের নদ–নদীর পানি। প্লাবিত হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। অনেক বছর পর এমন পানি দেখছে গ্রামবাসী। গত মঙ্গলবার সকালে ধামরাইয়ে। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন](https://images.prothomalo.com/prothomalo%2Fimport%2Fmedia%2F2020%2F08%2F13%2Ff08fc685ac3db4ca8be02b68ed4c2e89-5f34b91734f30.jpg?auto=format%2Ccompress)
পাঁচ-ছয় বছর ধরে দেশে বন্যা বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বন্যা বেড়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, ক্রমেই তা দৃশ্যমান হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে বন্যা আরও তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলে মনে করছেন বন্যা ও নদী বিশেষজ্ঞরা।
গত পাঁচ বছরে বন্যার পানি বৃদ্ধির পরিমাণ চারটি রেকর্ড ভেঙেছে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পানি ২০১৬ সালে আগের সব রেকর্ড ভেঙে সবচেয়ে উঁচুতে ওঠে। ২০১৭ ও ২০১৯ সালে তা উপর্যুপরি রেকর্ডভাঙা উচ্চতায় ওঠে। এ বছরের বন্যার পানি গত ১৩ জুলাই তিস্তা অববাহিকায় বিপৎসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। এটি এই অববাহিকার জন্য একটি রেকর্ড।
এ তো গেল পানির উচ্চতার দিক থেকে বন্যার নতুন রেকর্ড। স্থায়িত্বের দিক থেকেও চলমান বন্যা এরই মধ্যে ৪৫ দিন ধরে চলছে। স্থায়িত্বের দিক থেকেও এই বন্যা ১৯৯৮ সালের পর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বাংলাদেশে সাধারণত বছরে দুই ধাপে বন্যা আসে। জুলাই-আগস্টে একটি, আরেকটি আসে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। চলমান বন্যাটি জুনের শেষের দিকে আগাম শুরু হয়ে এখনো চলছে। তবে সেপ্টেম্বরে আরেকটি বন্যা আসার আশঙ্কা রয়ে গেছে বলে সংস্থাটি মনে করছে। তবে তা কবে আসবে, কত দিন স্থায়ী হবে ও কোন এলাকা বন্যাকবলিত হবে, তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে সেটি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়জন গবেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের সোসাইটি অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স যৌথভাবে বাংলাদেশের বন্যার ধরন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চলতি শতাব্দীর মধ্যে বন্যার ধরন কেমন হতে পারে, তা নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিজ্ঞানীদের প্যানেল আইপিসিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। তবে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বিশ্বকে বাসযোগ্য রাখতে হলে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে। সম্ভাব্য এই তিন তাপমাত্রার পরিবর্তনকে বিবেচনায় রেখে সামনে বন্যার ধরন কেমন হতে পারে, তা একটি গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে দেখিয়েছেন গবেষকেরা।
ওই গবেষণায় দেখা গেছে, এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে গঙ্গা অববাহিকায় বন্যার পরিমাণ ২৭ শতাংশ বাড়তে পারে। তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বন্যা ৫৪ শতাংশ বাড়তে পারে। আর ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় তা বেড়ে যথাক্রমে ২৪ ও ৬৯ শতাংশ পর্যন্ত। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বন্যার মুখে পড়বে মেঘনা অববাহিকা। সেখানে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি বাড়লে বন্যা ৩৮ শতাংশ ও ৪ ডিগ্রি বাড়লে বন্যা ৮১ শতাংশ বেশি হতে পারে।
এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন বুয়েটের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা আমরা করছিলাম, এরই মধ্যে তার ফলাফল দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। তবে এই পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোতে আমাদের অবকাঠামো নির্মাণের ধরনে বদল আনতে হবে। প্রতিটি সড়ক ও অবকাঠামোতে জলকপাট এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা রাখতে হবে। বিশেষ করে সড়কগুলোতে পানিপ্রবাহের ব্যবস্থাপনা যুক্ত না করলে বন্যার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে।’
জানতে চাইলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় গত এক যুগে বন্যা বেড়ে যাওয়া আমরা প্রত্যক্ষ করছি। আর বাংলাদেশে যত পানি আসছে, তার বেশির ভাগ ব্রহ্মপুত্র দিয়ে আসছে। ওই পানি মেঘনা দিয়ে পদ্মা হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ছে। ফলে বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে বাড়ছে।