রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা
তেজস্ক্রিয় বর্জ্য, দুর্ঘটনার দায় ও জনবল নিয়ে দুর্ভাবনা

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে বিশেষ দুর্ভাবনার বিষয় হচ্ছে এর তেজস্ক্রিয় বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা, সম্ভাব্য সব রকম দুর্ঘটনার দায় নেওয়া এবং প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও পরিচালনার সব পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সক্ষম জনবলের সংস্থান।
রূপপুর প্রকল্প নিয়ে আয়োজিত এক আলোচনায় দেশের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এই দুর্ভাবনার কথা বলেন। গত মঙ্গলবার সকালে প্রথম আলোর কার্যালয়ে ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প: স্বপ্ন ও বাস্তবতা’ শীর্ষক এই আলোচনার আয়োজন করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রূপপুর প্রকল্পের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য রাশিয়া ফিরিয়ে নিতে সম্মত না হলে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তে অটল থাকা কঠিন হবে। কারণ, এই বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের পক্ষে প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। রাশিয়ার সঙ্গে সই হওয়া চুক্তি (জেনারেল কন্ট্রাক্ট) অনুযায়ী এই প্রকল্পের যেকোনো পর্যায়ে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতির দায়িত্ব (নিউক্লিয়ার লায়াবিলিটি) নেওয়াও সম্ভব নয়। সর্বোপরি প্রকল্পের জন্য জনবল সংস্থানের যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তা-ও সন্তোষজনক নয়।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই আলোচনায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের (বিএইসি) সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আবদুল মতিন বলেন, রূপপুর প্রকল্পের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য রাশিয়া ফেরত নেবে কি না, এখন পর্যন্ত তা নিশ্চিত না হওয়া দুশ্চিন্তার বিষয়। কারণ, বাংলাদেশের পক্ষে এই বর্জ্য-ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রায় অসম্ভব। শত শত বছর ধরে এই বর্জ্য বিশেষ ব্যবস্থায় বিশেষ স্থানে সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশের পক্ষে এই ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়।
পারমাণবিক দুর্ঘটনার দায় নেওয়া সম্পর্কে আবদুল মতিন বলেন, রূপপুরে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আশপাশের ৩০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বৃত্তাকার এলাকা থেকে সব মানুষকে সরিয়ে নিতে হবে। তাঁদের দীর্ঘ সময়ের জন্য অন্যত্র পুনর্বাসন করতে হবে। কোনো বিবেচনায়ই বলা যায় না যে বাংলাদেশের এই সামর্থ্য আছে। তিনি বলেন, পারমাণবিক দুর্ঘটনার জন্য নির্মাণকারীদেরও দায়িত্ব নিতে হবে—এমন একটি আইন ভারত করেছে। এ রকম একটি সুরক্ষা আইন বাংলাদেশেরও করা উচিত।
প্রকল্পের ব্যয় সম্পর্কে আবদুল মতিন বলেন, ভারতের তামিলনাড়ুর কুদনকুলম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নতুন দুটি ইউনিট (তৃতীয় ও চতুর্থ) স্থাপনের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, তাতে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ পড়বে তিন হাজার মার্কিন ডলার। রূপপুর প্রকল্পে এই খরচ পড়ছে সাড়ে পাঁচ হাজার ডলার। যদিও কুদনকুলম কেন্দ্রটিতে ‘ভিভিইআর-১০০০’ রিঅ্যাক্টর ব্যবহার করা হচ্ছে, আর রূপপুরে করা হচ্ছে ‘ভিভিইআর-১২০০’, তবু রূপপুরের ব্যয় অপেক্ষাকৃত বেশি।
গোলটেবিল আলোচনায় বিএইসির সাবেক চেয়ারম্যান এম এ কাইউম বলেন, দেশের সবাই একটি নিরাপদ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চায়। এ জন্য তেজস্ক্রিয় বর্জ্য রাশিয়ার ফেরত নেওয়ার বিষয়টির সুরাহা হওয়া দরকার। বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সই হওয়া চুক্তিতে এ বিষয়ে প্রকৃতপক্ষে কী আছে, তা দেশের মানুষ এখন পর্যন্ত জানে না। তিনি বলেন, কোনো দেশে পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করার জন্য যে রকম জনবল থাকা প্রয়োজন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের তা নেই। রূপপুর প্রকল্পকে সামনে রেখে জনবল তৈরির যে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে, তা-ও সন্তোষজনক নয়। এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। কিন্তু আদৌ তা করা হবে কি না, কেউ জানে না। তাই রূপপুর প্রকল্প নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা-ও কেউ বলতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রায় ৩০ বছর কাজ করে অবসর নেওয়া বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম আলোচনায় অংশ নেন। তিনি বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ হিমশিম খাচ্ছে। তাই বর্জ্য ফিরিয়ে নিতে রাজি না হলে কোনো দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করা উচিত নয়।
পারমাণবিক দুর্ঘটনার দায় নেওয়ার বিষয়ে সাধারণ চুক্তির শর্ত প্রসঙ্গে নূরুল ইসলাম বলেন, রূপপুর প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী, যন্ত্রপাতি নির্মাণ ও সরবরাহকারী হচ্ছে রাশিয়া। প্রকল্পের সমীক্ষা থেকে শুরু করে সবকিছুই (এ টু জেড) করবে তারা। অথচ দুর্ঘটনার কোনো দায় তারা নেবে না। প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিচালনার যেকোনো পর্যায়ে, যেকোনো কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় প্রকল্পের স্বত্বাধিকারী হিসেবে বাংলাদেশের ওপর বর্তাবে। এটা কোনো গ্রহণযোগ্য চুক্তি হতে পারে না।
রূপপুরে পানিস্বল্পতার কথা উল্লেখ করে নূরুল ইসলাম বলেন, সেখানে ‘ওয়াটার টাওয়ার’ করা হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় পানির অভাব পূরণের জন্য। কিন্তু যদি কোনো রকম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তখন যে বিপুল পরিমাণ পানি দরকার হবে, তার উৎস কী হবে।
বিএইসির সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রেজাউর রহমান গোলটেবিল আলোচনায় বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দীর্ঘদিনের স্বপ্ন থেকে এখন বাস্তবের একটি বিষয়। এই বাস্তবের কতগুলো অত্যন্ত কঠিন দিক আছে। তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নিজস্ব সামর্থ্য, জনবল, পারমাণবিক দুর্ঘটনার দায় নেওয়া প্রভৃতি সে রকমই কঠিন কিছু বিষয়। এগুলোর সুরাহা না হলে নিরাপদ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের স্বপ্ন সফল হবে না।
গোলটেবিল আলোচনার প্রারম্ভিক বক্তব্যে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশের মানুষ একটি নিরাপদ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চায়। দেশবাসীর প্রত্যাশা হচ্ছে রূপপুর কেন্দ্রটি তেমন একটি নিরাপদ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়ে উঠুক।