তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনও নানা জটিলতায় পেছাচ্ছে

সরকারের পরিকল্পিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর মতো তেলচালিত নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনও নানা জটিলতায় বিলম্বিত হচ্ছে, পিছিয়ে যাচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রচলিত দরপত্র প্রক্রিয়া ছাড়া ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইন (বিশেষ বিধান)’-এর আওতায় প্রায় তিন বছরেও কোনো তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করা যায়নি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, প্রচলিত দরপত্র প্রক্রিয়ায় যেসব তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে, সেগুলোর চিত্রও একই রকম। এ বছরের শুরুর দিকে সরকার প্রতিটি ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১০টি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। গত মে মাসে এগুলোর জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলেও এখন পর্যন্ত কার্যাদেশ দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করা যায়নি; বরং কিছু ক্ষেত্রে নতুন করে জটিলতা দেখা দিয়েছে।
সরকার বিশেষ আইনের আওতায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে তিনটি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় ২০১৪ সালের শুরুর দিকে। ওই বছরের ২ মার্চ এ ব্যাপারে তিনটি বেসরকারি কোম্পানির প্রস্তাব নেওয়া হয়। প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করে প্রধানমন্ত্রীর বরাবর উপস্থাপন করা হলে তিনি অনুমোদন দেন ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি। প্রধানমন্ত্রীর এই অনুমোদনের প্রায় ২৩ মাস পর, গত ১৩ নভেম্বর ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার জন্য একটি কোম্পানির সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চুক্তি করে। এটি স্থাপনের কাজ শুরু হতে আরও কিছুদিন লাগবে।
এ ছাড়া অন্য দুটি কোম্পানির সঙ্গে এখনো বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিও সম্পন্ন হয়নি। ওই কোম্পানি দুটি ১০০ মেগাওয়াট করে মোট ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। এই কেন্দ্রগুলো বিশেষ আইনের আওতায় স্থাপনের যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল, প্রচলিত দরপত্র প্রক্রিয়ায় সময় বেশি লাগার কথা। কিন্তু প্রায় তিন বছরেও এই কেন্দ্রগুলো স্থাপনের কাজ শুরু না হওয়ায় সেই যুক্তির অসারতা প্রমাণিত হয়েছে।
ওই তিনটি কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলা অবস্থায়ই, চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রচলিত দরপত্র প্রক্রিয়ায় মোট ১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১০টি কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। গত মে মাসে এই কেন্দ্রগুলোর জন্য আহ্বান করা দরপত্র গত আগস্ট মাসে খুলে মূল্যায়ন করা হয়। এরপর দরপত্রে অংশ নেওয়া কয়েকটি কোম্পানির পারস্পরিক অভিযোগের ভিত্তিতে চারটি কেন্দ্রের পরবর্তী বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অসত্য তথ্য ও জাল কাগজপত্র দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগে ওই চারটি কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া বন্ধ করা হয়েছে। এখন এসব অভিযোগের তদন্ত চলছে। এখন পর্যন্ত তদন্তে একটি কোম্পানির বিষয়ে জানা গেছে, তারা দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের অভিজ্ঞতার যে উল্লেখ করেছিল, তা যথাযথ নয়। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী তাদের নিজেদের শিল্পে ব্যবহারের জন্য ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ (ক্যাপটিভ পাওয়ার) উৎপাদনের অভিজ্ঞতা থাকতে হতো। কিন্তু অভিজ্ঞতা আছে পাঁচ মেগাওয়াটের।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দরপত্র প্রক্রিয়া চলার মধ্যেও কোম্পানিটির বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতার বিষয়ে একাধিকবার তদন্ত করা হয়। কিন্তু এই তদন্তে একেকবার একেক রকম তথ্য এসেছে। তবে একবারও ২০ মেগাওয়াট আসেনি। কোম্পানিটিকে গ্যাস সরবরাহ করে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। ওই কোম্পানির অনুমোদন রয়েছে প্রতিটি দুই মেগাওয়াট করে দুটি জেনারেটরে গ্যাস সরবরাহের।
কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানির সূত্র জানায়, ওই শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি একবার অননুমোদিতভাবে কিছু বেশি গ্যাস ব্যবহার করেছিল। সে জন্য তাদের গ্যাস-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং ৪ কোটি ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৩৮২ টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া কোম্পানিটি নিয়মিত যে পরিমাণ গ্যাসের বিল পরিশোধ করে, তাতে পাঁচ মেগাওয়াট উৎপাদনেরই তথ্য পাওয়া যায়। তারপরও একই বিষয় তদন্ত করার জন্য আবার একটি কমিটি করা হয়েছে। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার ভিত্তিতে এই তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, সব কটি অভিযোগ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন এখনো আসেনি। আসার পরে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বড় কেন্দ্রগুলোর বাস্তবায়ন পিছিয়ে যাওয়ায় তেলচালিত এসব কেন্দ্র স্থাপনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু এগুলোও বিলম্বিত হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। রূপকল্প ২০২১-এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হচ্ছে।
এই রূপকল্প অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। বর্তমানে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াট (চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি পাওয়া গেলে)।