তৈরি পোশাকের সেই 'দেশ'

>তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্ব বাজারে চীনের পর এখন বাংলাদেশের অবস্থান। এই তৈরি পোশাকশিল্পের যাত্রা হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকেই। যে পথ তৈরি করে দেশ গার্মেন্টস

বেলা সোয়া একটা। হঠাৎ বেজে উঠল সাইরেন। থেমে গেল মেশিনের চাকা। ৮০ হাজার বর্গফুটের বিশাল ফ্লোরটি নিমেষেই খালি। সাইরেনের আগে ছিল শ্রমিকদের ব্যস্ততা। সুঁই সুতার মিতালি। হঠাৎ কী হলো? শ্রমিকেরা যাচ্ছেন কোথায়? তবে ভয়ের কিছু নেই। এই সংকেত দুপুরের খাবারের।

দেশ গার্মেন্টেসের কালুরঘাট কারখানায় বিদেশি ক্রেতাকে পোশাক দেখাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের পিরচালক ভিদিয়া অমৃত খান l ছবি : সংগৃহীত
দেশ গার্মেন্টেসের কালুরঘাট কারখানায় বিদেশি ক্রেতাকে পোশাক দেখাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের পিরচালক ভিদিয়া অমৃত খান l ছবি : সংগৃহীত

সামনে পুকুর। গাছগাছালি, ফুলের টব। এক তলা লম্বা ভবনটি বাদ দিলে সীমানা দেয়ালের ভেতর অনেক খালি জায়গা। তারই বিভিন্ন স্থানে, এলোমেলোভাবে এখানে-সেখানে বসে খাবার খাচ্ছেন শ্রমিকেরা। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খাবার শেষ করে আবারও ফিরলেন যার যার নির্দিষ্ট টেবিলে। আবার সচল সেলাই মেশিনের চাকা। সেই পরিচিত শব্দ, বুননের কোলাহল। চলছে নানা রঙের, আকারের শার্ট তৈরির কাজ। শ্রমিকের টেবিলে টেবিলে ঘুরে কাজ তদারকি করছেন কর্মকর্তারা।
এ চিত্র চট্টগ্রামের কালুরঘাট বিসিক শিল্প এলাকায় স্থাপিত তৈরি পোশাক কারখানা ‘দেশ গার্মেন্টসের’। এইটুকু বললে হয়তো আর দশটি সাধারণ তৈরি পোশাক কারখানার মতোই। কিন্তু এই ‘দেশ’ সাধারণের চেয়ে বেশি কিছু। যে পোশাক কারখানার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ইতিহাস, গর্ব। ‘দেশের’ হাত ধরেই শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির পথচলা। সেটি ১৯৭৮ সালে।

দেশ গার্মেন্টসের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ নুরুল কাদের
দেশ গার্মেন্টসের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ নুরুল কাদের

সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে মোহাম্মদ নুরুল কাদের গড়ে তুলেছিলেন এ তৈরি পোশাক কারখানাটি। তখন বাংলাদেশে শ্রমিক থেকে মালিক কারওরই তৈরি পোশাক কারখানার পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই শুরুতে গাঁটছড়া বেঁধেছিল দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান ‘দাইয়ু’ এর সঙ্গে। ১৩০ জনকে দক্ষিণ কোরিয়ায় নিয়ে গিয়ে ছয় মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্যে শ্রমিক থেকে শুরু করে কর্মকর্তারাও ছিলেন। যাঁদের অনেকে এখন নিজেরাই পোশাকশিল্প মালিক।
গত মঙ্গলবার নগরের কালুরঘাটে দেশ গার্মেন্টস সরেজমিন পরিদর্শনকালে এটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম জানান, বর্তমানে ৯০০ শ্রমিক কাজ করেন এ গার্মেন্টসে। যার মধ্যে ৬৫০ জনই নারী। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি কেবল শার্টই তৈরি করে চলেছে। তিনি আরও জানান, দেশের প্রথম রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস হলেও গত ৩৭ বছরে এটির উৎপাদন কার্যক্রমের তেমন একটা সম্প্রসারণ হয়নি।
৩৭ বছরের পুরোনো এ প্রতিষ্ঠানে ৩৬ বছর ধরে কর্মরত শ্যামল কান্তি ঘোষ। ১৯৭৯ সালের হিসাবরক্ষক হিসেবে এক হাজার টাকা বেতনে যোগ দিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটিতে। এখনো আছেন হিসাব বিভাগে। বয়স এখন সত্তর ছুঁইছুঁই। দীর্ঘদিন ধরে এক প্রতিষ্ঠানে চাকরির কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘শুধু চাকরি নয়। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কটা এখন অনেক বেশি পারিবারিক।’
প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে আমেরিকার খোলস্, সিয়ানজন, ইউরোপের আলদি, সিকে ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করা হয়। প্রতিদিনের উৎপাদন ক্ষমতা ৮ থেকে ৯ হাজার পিস।
শ্রমিকেরা জানান, শ্রমিকদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ছয়টি বাসের ব্যবস্থা রয়েছে। এ কারণে কালুরঘাটের আশপাশে উপজেলা ও শহরতলীর নিজেদের বাড়ি থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করেন অনেক শ্রমিক। তাঁদেরই একজন বোয়ালখালীর মোহাম্মদ সেলিম। ২০ বছর বয়সে এসএসসি পাস করে ৩৫০ টাকা বেতনে হেলপার পদে যোগ দেন তিনি। পদোন্নতি পেয়ে এখন হয়েছেন জ্যেষ্ঠ অপারেটর। তিনি বলেন, এ প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পরই সংসার হয়েছে। দুই ছেলে, এক মেয়ে তাঁর। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। যখনই কোনো বিপদে পড়েছেন বেতনের বাইরেও নানা আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন মালিকের কাছ থেকে। তাই বয়স বাড়লেও প্রতিষ্ঠানটির চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছে জাগেনি। তবে ঝড়-ঝাপটা কম সইতে হয়নি দেশকে। অনেকটা খাদের কিনারে চলে গিয়েছিল। ৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মূল কারখানাটি। তখন কারখানার কার্যক্রম আগ্রাবাদে স্থানান্তর করা হলেও মূল কারখানাটি বন্ধ ছিল প্রায় পাঁচ বছর। ১৯৯৬ সালে এসে এটিতে পুনরায় কার্যক্রম শুরু হয়। দেশের প্রথম গার্মেন্টস কারখানা হিসেবে ব্যাক টু ব্যাক এলসি (লেটার অব ক্রেডিট), কারখানায় বন্ডেড ওয়্যার হাউস থেকে শুরু করে সবকিছুর প্রবক্তা ছিল দেশ গার্মেন্টস। ওই সময় বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমেই কারখানাটির আর্থিক লেনদেন হতো। ঘূর্ণিঝড়ের পর কারখানা ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ বাবদ বিমার অর্থ দাবি করা হয় বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে। কিন্তু যে বছর এ দাবি করা হয় ওই বছরই বিদেশি প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ফলে বিমার টাকা আর পাওয়া হয়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পড়ে ১৯৯১ সালেই কোম্পানিটিকে ১৩ কোটি টাকার লোকসান দিতে হয়।

কারখানায় কর্মব্যস্ত শ্রমিকেরা
কারখানায় কর্মব্যস্ত শ্রমিকেরা

এরপর ১৯৯৬ সালে পুনরায় কার্যক্রম শুরু হলেও দুই বছরের মাথায় এসে ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে কারখানার স্বপ্নদ্রষ্টা মোহাম্মদ নুরুল কাদের মারা যান। আবারও ধাক্কা খায় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ২০০৫ সালে বিদেশ থেকে পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরে ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন নুরুল কাদেরের মেয়ে ও দেশ গার্মেন্টসের বর্তমান পরিচালক ভিদিয়া অামৃতা খান। একটু একটু করে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে গার্মেন্টসটি।
ভিদিয়া অমৃত খান বলেন, ‘আর্থিকভাবে চরম দুর্দিনে পড়ে এবং বাবার মৃত্যুর পরও আমরা কারখানাটি বন্ধ করিনি। কারণ এটির সঙ্গে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ইতিহাস জড়িত। তবে দেশের প্রথম গার্মেন্টস হিসেবে এটির যে সম্প্রসারণ হওয়ার কথা সেটি হয়নি। কারণ প্রথম কারখানা হিসেবে পথচলায় ধাপে ধাপে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়েছে। সব প্রতিকূলতা জয় করে এখন কারখানাটি একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। তাই চলতি বছরই নতুন করে সম্প্রসারণে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’
প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে ভিদিয়া বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে ৩৫-৩৬ বছরের পুরোনো অনেক শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা শুধু ‘মালিক-শ্রমিক’ সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি সম্পর্ক অনেকটাই পারিবারিক। আমার প্রয়াত পিতা ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সকলের অভিভাবক। আমরা ভাই-বোন মিলে সেই সম্পর্ক বজায় রেখেছি নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী।’