তৈরি পোশাক খাতে নারী শ্রমিক কমছে

>
তৈরি পোশাক খাতে নারীর অংশগ্রহণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি মূল কারণ।

নারী শ্রমিকদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তৈরি পোশাক খাতে নারীরাই পিছিয়ে পড়ছেন। এই খাতে নারী শ্রমিক কমে যাচ্ছে। নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা এখন বেশি। অথচ দেশে তৈরি পোশাক কারখানা ও শ্রমিকের সংখ্যা দুই-ই বেড়েছে। বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, পোশাকশিল্প খাতে পুরুষ এখন ৫৩ দশমিক ৮২ শতাংশ; বিপরীতে নারী আছেন ৪৬ দশমিক ১৮ শতাংশ।

প্রযুক্তি ও দক্ষতায় ঘাটতি, বেতন বাড়ায় পুরুষদের আগ্রহ বৃদ্ধির কারণে তৈরি পোশাক খাতে (গার্মেন্টস) নারী শ্রমিকেরা পিছিয়ে পড়ছেন। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নারীদের দক্ষ করতে এখনই পদক্ষেপ না নিলে নারীদের কয়েক যুগের এই পেশা টিকিয়ে রাখা কঠিন বলে মনে করছেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা।

বিগত চার বছরের ব্যবধানে পোশাকশিল্প খাতে নারীর অংশগ্রহণ ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তির দুটি পৃথক জরিপ বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বেসরকারি একাধিক জরিপেও নারী শ্রমিক কমে যাওয়ার এই প্রবণতা উঠে এসেছে। এ খাতে মোট ৩৩ লাখ ১৫ হাজার মানুষ কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে সিংহভাগই শ্রমিক। শেষের জরিপটি ২০১৮ সালে প্রকাশ করা হয়। 

২০১৩ সালের একই জরিপে দেখা গেছে, পোশাকশিল্প খাতে পুরুষের অংশগ্রহণের হার ছিল ৪৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। যেখানে নারীদের হার ছিল ৫৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। তখন এই খাতে ২৯ লাখ ৯৭ হাজার লোক জড়িত ছিল। 

নারী শ্রমিক কমে যাওয়ার বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরিচালক প্রতিমা পাল মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, প্রযুক্তির পরিবর্তনের কারণে সেলাই জানার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পোশাক খাতে নারীদের রাজত্ব করার সুযোগ নেই। কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে নারীদের দক্ষ হতে হবে। 

এই দুটি জরিপ আরও বলছে, পোশাক খাতে ২০১৩ থেকে ২০১৬-১৭ সালে কর্মসংস্থানের গড় প্রবৃদ্ধি পুরুষের ক্ষেত্রে ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে নারীদের কর্মসংস্থানের গড় প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ কমেছে।

সরকারি-বেসরকারি জরিপে একই প্রবণতা
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সত্তরের দশক থেকে দেশে তৈরি পোশাক খাতের যাত্রা শুরু। তখন এ খাতে মূলত নারীরাই কাজ করতেন। নব্বইয়ের দশক থেকে নিটওয়্যার গার্মেন্টস যাত্রা শুরুর পর থেকে নারীদের অংশগ্রহণের হার কমতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইউএন উইমেনের সহায়তায় ২০১৮ সালে দেশের ২৬০টি তৈরি পোশাক কারখানায় একটি জরিপ চালানো হয়। এতে দেখা যায়, ২০১৮ সালে তৈরি পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণের হার ৬০ শতাংশ। ২০১০ সালে এই হার ছিল ৬৩ শতাংশ। চলতি সেপ্টেম্বরে জরিপের ফল প্রকাশের কথা।

গবেষণাটি পরিচালনা করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে নারী শ্রমিকের হার কমে আসছে, যা উদ্বেগজনক। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জরিপেও একই প্রবণতা উঠে এসেছে। জরিপের তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে তৈরি পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের হার ছিল ৫৩ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ ২০১২ সালে সেই হার ছিল ৫৮ দশমিক ৪। 

কেন কমছে
তৈরি পোশাক খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, শিক্ষা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণে পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকের দক্ষতার ঘাটতি, বেতন বাড়ায় পুরুষের আগ্রহ বৃদ্ধি, সামাজিক বৈষম্য ও শ্রমঘন উৎপাদনশীল খাত হওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি এ খাতে পুরুষের তুলনায় নারীর কাজের গড় বয়সও কম। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য, গবেষক, তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক, ব্যবস্থাপক ও মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক দশক ধরে তৈরি পোশাকশিল্পে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। এসব যন্ত্র একই সঙ্গে অনেক ধরনের কাজ করতে পারে। আগে যেসব কাজ নারী শ্রমিকেরা করতেন, সেসব কাজ এখন যন্ত্রের মাধ্যমেই হয়ে যায়। আগে দুটি মেশিনের সুতা কাটার জন্য একজন সহকারী দরকার ছিল। এই কাজ মূলত নারীরাই করতেন। এখন মেশিনেই সুতা কাটার কাজটি হয়ে যায়। আবার একসময় তৈরি পোশাক খাতের কাজ নারীদের মনে করা হলেও বেতন–ভাতা বেড়ে যাওয়ায় পুরুষেরাও ঝুঁকছেন।

রাজধানীর মিরপুরে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন রেহানা আক্তার (২৭)। সকালে কাজে যাওয়ার আগে বাসায় রান্না করে রেখে যান। কাজ ও ওভারটাইম শেষে বাসায় এসে আবার রাতের রান্না চড়ান। মাঝখানে দুপুরে এক ঘণ্টা বিরতিতে বাসায় এসে মেয়েকে খাওয়ান ও গোসল করান। রেহানা বলেন, ‘ভুল হইলে গালাগালির মাফ নাই, সারা দিন গার্মেন্টসে সতর্ক থাকন লাগে। রান্দা-বাড়ির কাম। মাইয়া দেহা, অসুখে পড়া শাশুড়িরে সেবাযত্ন করা। বড় ধকল যায় শরীলের ওপর। ছুটিও পাওন যায় না।’ 

 নারীরা শিক্ষা ও দক্ষতায় পিছিয়ে
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছেন। পুরুষদের মধ্যে দক্ষতা অর্জনের তাগিদ বেশি থাকে। নানা ধরনের প্রশিক্ষণ নেন তাঁরা। যে সময়টা নারীরা সংসার ও সন্তান সামলাতে ব্যস্ত থাকেন। 

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দক্ষ কর্মীর চাহিদা বাড়ছে। পাশাপাশি কায়িক শ্রমভিত্তিক কাজ হওয়ায় এ খাতে নতুনভাবে নারীদের সম্পৃক্ত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। আবার সন্তান-সংসার সামলাতে নারীরা চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নারীদের দক্ষ করতে এখনই পদক্ষেপ না নিলে নারীদের কয়েক যুগের এ পেশা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। সিপিডির গবেষণা অবশ্য বলছে, একজন নারী শ্রমিক গড়ে সাত বছরের বেশি কাজ করতে পারেন না। সরেজমিনে ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সন্তান হওয়ার পর নারী কর্মীদের একটি বড় অংশ ঝরে যায়। 

সীমিত কাজের খাত
সুইং, ফিনিশিং, কাটিং, এমব্রয়ডারি, নিটিং, ওয়াশিং—তৈরি পোশাক খাতে মূলত এই ছয় ধরনের কাজ হয়। যার মধ্যে নারীরা সবচেয়ে বেশি কাজ করেন সুইংয়ে, তারপর ফিনিশিংয়ে। অন্য খাতগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ খুব কম। এমব্রয়ডারি, ওয়াশিংয়ে নেই বললেই চলে। তবে নারীরা মূলত শ্রমিক হিসেবেই কাজ করেন। ব্যবস্থাপনায় এ সংখ্যা হাতে গোনা। এসব কাজে নারীদের নিয়োজিত না করার জন্য মালিকদের প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি দায়ী বলে জানা গেছে।