ত্বকী হত্যার তদন্তই শেষ হয় না

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার বিচার প্রায় শেষ হয়ে এলেও কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলায় এখনো তদন্তই শেষ হয়নি। অথচ ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে সাত খুনের ঘটনার এক বছর আগে।
ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি প্রথম আলোকে বলেছেন, সাত খুনের মতো জটিল মামলার রায় সোয়া তিন বছরে হয়ে গেছে। অথচ ত্বকী হত্যার সব সত্য উদ্ঘাটিত হওয়ার পরও অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে না।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জ শহরের বাসার সামনে থেকে নিখোঁজ হয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মুহাম্মদ। ওই দিনই সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন রাব্বি। ৮ মার্চ সকালে শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা চারারগোপ এলাকার খালে ত্বকীর লাশ পাওয়া যায়। ওই দিন রাতেই ত্বকীর বাবা অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন। পরে ১৮ মার্চ সাংসদ শামীম ওসমান, তাঁর ছেলে অয়ন ওসমান, জেলা যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা জহিরুল ইসলাম পারভেজ ওরফে ক্যাঙারু পারভেজ, জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি রাজীব দাস, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান, সালেহ রহমান সীমান্ত ও রিফাতকে দায়ী করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন রফিউর রাব্বি।
রফিউর রাব্বি বলেন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী বিভিন্ন পরিবহনের মালিকেরা ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন। তিনি এই চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় তাঁকে শায়েস্তা করতে ছেলেকে খুনের পরিকল্পনা করা হয়। র্যাবের তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। গণমাধ্যমেও তা প্রকাশিত হয়েছে।
ত্বকী হত্যা মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে পুলিশ। পরে রফিউর রাব্বির রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের নির্দেশে মামলাটি র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাব ইউসুফ হোসেন ওরফে লিটন, সুলতান শওকত ও তায়েবউদ্দিন ওরফে জ্যাকিকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে ইউসুফ ও সুলতান শওকত আদালতে দোষ স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
জবানবন্দিতে ইউসুফ বলেন, জাতীয় পার্টির নেতা হাজি রিপনের জামতলার বাড়িতে তাঁর ছেলে সালেহ রহমান ওরফে সীমান্ত, ভ্রমর, আবুল কালাম সিকদারসহ অন্যরা নির্যাতন চালানোর পর শ্বাসরোধে ত্বকীকে হত্যা করেন। পরে লাশ ব্যাগে ভরে নৌকায় করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
এই মামলার আরেক আসামি সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, ত্বকী হত্যার নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক সাংসদ নাসিম ওসমানের (এখন প্রয়াত) ছেলে আজমেরী ওসমান। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ রাতে শহরের কলেজ রোডে আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ত্বকীকে খুন করা হয়। খুনের পর লাশ বস্তাবন্দী করে আজমেরী ওসমানের গাড়িতে তুলে চারারগোপে নিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
এই জবানবন্দির পর র্যাব-১১-এর একটি দল নারায়ণগঞ্জ শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে আজমেরী ওসমানের মালিকানাধীন উইনার ফ্যাশনের কার্যালয়ে অভিযান চালায়। সেখান থেকে রক্তমাখা একটি জিনসের প্যান্ট ও কাপড়ে প্যাঁচানো রক্তমাখা গজারির দুটি লাঠি উদ্ধার করা হয়। সেখানকার রান্নাঘরের মেঝেতে রক্তের দাগ পাওয়া যায়। র্যাব আজমেরীর কার্যালয়ের ভেতর ও বাইরে
লাগানো আটটি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা, এলসিডি মনিটর, গুলির চিহ্ন থাকা একটি কর্নার শোকেস, একটি সোফা, পিস্তলের বাঁটের ভাঙা অংশ, দুটি টেঁটা ও ইয়াবা সেবনের সরঞ্জামাদি জব্দ করে।
ওই অভিযানের সময় সেখানে আজমেরী ওসমান ছিলেন না। সেখান থেকে তাঁর দুই গাড়িচালক ও এক নিরাপত্তা প্রহরীকে র্যাব আটক করে এবং জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেয়।
এরপর চার বছর পার হলেও তদন্ত শেষ হয়নি। এরই মধ্যে আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে গেছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া দুই আসামি।
মামলাটির তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব-১১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ত্বকী হত্যা মামলার তদন্ত চলছে। আদালতে তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন যথারীতি জমা দেওয়া হচ্ছে।
তবে ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি অভিযোগ করেন, সরকারি দলের সাংসদ শামীম ওসমান ও তাঁর বড় ভাই সাবেক সাংসদ নাসিম ওসমানের ছেলে জড়িত থাকায় ত্বকী হত্যা মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে গেছে।