থানাপাড়া গণহত্যা দিবস আজ, দাবি একটি নামফলকের
কুষ্টিয়ার থানাপাড়া। ১৯৭১–এর ২৮ আগস্ট। এই দিনটিকে স্মরণ করা হয় থানাপাড়া গণহত্যা দিবস হিসেবে।
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে কুষ্টিয়ায় বড় ধরনের বন্যা হয়। কোর্টপাড়া ও হাউজিং এলাকাসহ শহরের প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ এলাকা বুকপানিতে তলিয়ে যায়। প্রথমবারের মতো গোরস্তান বন্ধ করে দেওয়া হয়। সীমিত আকারে চালু করা হয় মজমপুরের পুরোনো গোরস্তান। তবে শহরে মানুষ কম থাকায় গোরস্তানের প্রয়োজন তেমন ছিল না।
জুন মাস থেকেই পরিত্যক্ত বাড়িঘর আর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দালাল বাঙালি আর অবাঙালিদের মধ্যে বিলিবণ্টনের কাজ শুরু করে দেয় দখলদার প্রশাসন। তাই এপ্রিলে শহর ছেড়ে চলে যাওয়া অনেকে জুলাই মাসের দিকে ঘরবাড়ি রক্ষার জন্য পরিবারের দু–একজনকে শহরের ফেরত পাঠাতে চেষ্টা করে। এঁরা দিনে থাকলেও রাতে নিরাপদ কোন আশ্রয়ে চলে যেতেন। বন্যার করণে সেই চলাফেরাটা নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়।
পাকিস্তানিদের সহযোগী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের চক্রান্তে আগস্টের ২৮ তারিখ রাতে থানাপাড়ার বিভিন্ন বাড়ি থেকে আট–দশজন যুবককে ধরে এনে ছয় রাস্তার মোড়ে জড়ো করা হয়। এঁদের অনেকেই এপ্রিল থেকে এযাবৎ গ্রামে গ্রামে কাটিয়েছেন। আবার কেউ বন্যার কারণে, কেউ ফেলে যাওয়া ঘরবাড়ির দেখাশোনার জন্য শহরে এসেছিলেন। ছয় রাস্তার মোড়ের কাছেই আবদুস সবুর নামে একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। যুদ্ধের আগের বছর পরিবহন ব্যবসা শুরু করেন। ট্রাক ছিল তাঁর। ট্রাকের দুজন শ্রমিকসহ তাঁকে হত্যা করা হয়। শ্রমিক দুজনের নাম–ঠিকানা জানা যায়নি।
ভেড়ামারা হাইস্কুলের তরুণ বিজ্ঞান শিক্ষক কামাল উদ্দিন শেখ ফেরত এসেছিলেন মেহেরপুর থেকে। সঙ্গে তাঁর এক শিশু বয়সী ভাই নুরুল ইসলাম শেখ। উদ্দেশ্য ছিল ছয় রাস্তার মোড়ের তাঁদের বাড়িটা রক্ষা করা আর পরিস্থিতি বুঝে একে একে পরিবারের অন্য সদস্যদের ফিরিয়ে আনা। এই দুই ভাইকেও হত্যা করা হয় সেই রাতে। তাঁদের পিতা নাজির আহমেদ শেখ ছিলেন কুষ্টিয়া সদর মহকুমা অফিসের প্রধান সহকারী।
অবিভক্ত নদীয়া জেলার নির্বাচিত জেলা পরিষদ সভাপতি এবং পরবর্তী সময়ে কুষ্টিয়া জেলার জি পি খানবাহাদুর শামসুজ্জহার পুত্র ব্যবসায়ী ওবায়দুর রহমান বুলু একাই বাড়ির দেখাশোনা আর বকেয়া কিছু কাজ করার জন্য গ্রাম থেকে শহরের বাড়িতে এসেছিলেন। তাঁকেও সে রাতে ধরে নিয়ে আসে হানাদারদের দোসর উর্দুভাষী আর জামাতিরা। তাঁর পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তাঁদের প্রতিবেশী কুষ্টিয়া শহর রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার এবং ‘পাক রেস্তোরাঁর’ মালিক উর্দুভাষী নেসার খাঁ এবং কুষ্টিয়া শান্তি কমিটির প্রধান সাদ আহমদ সেই রাতে ছয় রাস্তার মোড়ে অবস্থান করে হত্যার দিকনির্দেশনা দেন। এই নেসারই ওবায়দুর রহমান বুলুকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যান। এ ঘটনার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন তাঁর ছোট ভাই, তখন মেডিকেল ছাত্র শওকত হায়াত শ্যামা। ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পেরে নেসারদের হাতে ধরা পড়ার আগেই ছোট ভাইকে অন্য দরজা দিয়ে বের করে দেন। শওকত হায়াত পাশের বাসায় আশ্রয় নিয়ে বেঁচে যান। বলে রাখা ভালো, থানাপাড়া গণহত্যার হোতা সাদ আহমদ তরুণ বয়সে শহীদ ওবায়দুর রহমান বুলুর পিতা খান বাহাদুর শামসুজ্জহার হাত ধরে তাঁদেরই বাড়িতে থেকে আইন ব্যবসার প্রাথমিক তালিম পেয়েছিলেন।
শহরের প্রধান সড়ক হাই রোডের আমতলার কেরোসিন বিক্রেতা তরুণ দিনু ওরফে দিন মহাম্মদকেও সেদিন উঠিয়ে নিয়ে আসে তারা। শেষ পর্যন্ত দিনুকে তারা সারা রাত আটকে রেখে ছেড়ে দিলেও বাকিদের জিকের ঘাটে (যেখানে এখন শেখ রাসেল সেতু নির্মিত হয়েছে) নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে গড়াই নদে ফেলে দেয়। তাঁদের লাশের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। দিনুর বয়ান অনুযায়ী, কুষ্টিয়ার তৎকালীন জামায়াত নেতা মহিউদ্দিন ওই হত্যাকারীদের সঙ্গে ছিল। তাঁকেসহ সাতজনকে যখন নদীর ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন ঘাটে বাঁধা জ্বালানি কাঠ (খড়ি)-এর নৌকার লোকজন জেগে গেলে নৌকায় থাকা তিনজনকে একসঙ্গে হত্যা করা হয়, নৌকার অন্য দুজন পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে গুলির হাত থেকে বাঁচলেও তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা জানা যায়নি। জনশূন্য জ্বালানি কাঠের সেই নৌকা অনেক দিন দাবিহীন পড়েছিল ঘাটে।
এই ঘাটে শহীদদের একটা নামফলকের দাবি কি খুব বড় দাবি?
গওহার নঈম ওয়ারা। একাত্তরের সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থের লেখক