থ্যাংক ইউ ক্যাপ্টেন, জার্সি নম্বর '২'-এর বিদায়

মাশরাফি বিন মুর্তজা
মাশরাফি বিন মুর্তজা

ক্রিকেট বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। আর মাশরাফি বিন মুর্তজা বাংলাদেশ ক্রিকেটের সফল এক নেতৃত্বের নাম। যাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনে অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত এবং জয়ের ইতিহাস রয়েছে। ৬ মার্চ সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মি. ফ্যান্টাস্টিকের অধিনায়ক হিসেবে মাঠে খেলার শেষ দিন।

নড়াইল এক্সপ্রেস মাশরাফির কারণে বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলা জনসাধারণের কাছে এত জনপ্রিয়। যাঁর নেতৃত্বে ছিল বিচক্ষণতা, সরলতা, বন্ধুত্ব, ক্রিকেট টিমে সতীর্থকে সফল করার সব রকম কৌশল। মাশরাফিকে খেলোয়াড় হিসেবে দেখা যাবে, কিন্তু ২২ গজের মাঠে আর অধিনায়ক হিসেবে দেখা যাবে না। যদিও ৫ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে অধিনায়ক থেকে অবসর যাওয়ার ঘোষণা দিলেন, ঘোষণাটি আরও ভালো হতো যদি ক্রিকেট বোর্ড প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান অবসরের অগ্রিম ঘোষণা না দিতেন। ঘোষণার সময় শান্ত ও আবেগহীন কণ্ঠে ছিলেন। কিন্তু চোখ ছলছল করেছিল এবং আমার চোখে তাঁকে একটু অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।

ক্রিকেট জীবনে ত্যাগী, পরিশ্রমী অধিনায়কের নাম মাশরাফি। কারণ, খেলোয়াড়ি জীবনে ৮–১০ বার অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁর। তবু এসব প্রতিবন্ধকতা তাঁকে থামাতে পারেনি। এমনকি মাঠে খেলা চালিয়ে গেছেন। কোনো কোনো সময় পেইন কিলার ইনজেকশন নিয়ে তিনি খেলেছেন। ১৯ বছর ধরে মি. ক্যাপ্টেনের ত্যাগ ও পরিশ্রম মূল্যায়ন করে অন্যান্য যেকোনো খেলোয়াড়ের চেয়ে তাঁকে আলাদাভাবে সম্মান জানানো উচিত। কেউ কেউ মনে করেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রদের গবেষণার বিষয় হতে পারেন তিনি। বাংলাদেশি অন্য খেলোয়াড়েরা ছোটখাটো চোটে পড়লে তাঁরাও ফিজিও চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনার আগে মাশরাফির সঙ্গে পরামর্শ করতেন।

মাশরাফির বিদায় মানে বৃষ্টি
মাশরাফি ছিলেন বিনয়ী ও ভদ্র। যা অন্য সব খেলোয়াড়ের মন্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করলে যে কেউ উপলব্ধি করতে পারেন। এমনকি অধিনায়কের শেষ ওয়ানডেতে এক ব্যক্তি কান্না করে মি. ফ্যান্টাস্টিকের হাত ধরে মাঠে আসছিলেন। তাতে বোঝা যায় মাশরাফি কতটুকু বিনয়ী ও ভালোবাসার প্রতীক ছিলেন অন্যদের কাছে। মাশরাফিকে প্রকৃতি বিদায় দিয়েছে বলে মনে হয়েছে। বৃষ্টি শান্তির প্রতীক, যা মাশরাফির বিদায়ী সময়ে প্রতিফলিত। যেমন ২০১৭ সালে তিনি যখন শ্রীলঙ্কায় টি-২০ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন, ওই দিনও বৃষ্টি ছিল। তেমনি ওয়ানডেতে বিদায় নেওয়ার সময় সিলেটে বৃষ্টি হয়েছে।

মাশরাফি ২০১৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেটকে যে পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন, বিশেষ করে ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের যে অবস্থান, সেটা সম্ভব হয়েছে একমাত্র মাশরাফির সফল নেতৃত্ব ও সব খেলোয়াড়ের মানসিক দিক বিবেচনা করে দলকে পরিচালনা সার্থক নেতৃত্বেরই প্রতিফলন। বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির জয়ের হার ৫০ শতাংশের বেশি এবং তা সর্বোচ্চ। এটি মাশরাফির ব্যতিক্রমী সফলতা ও অন্যান্য অর্জনের মধ্যে একটি।

মাশরাফি নেতা হিসেবে ছিলেন ব্যতিক্রমী। কারণ, কোনো খেলোয়াড় বিপদে পড়লে তাঁকে সহযোগিতা করেছেন, বিপদের সময় আগলে ধরেছেন, যেমন তামিম, তাসকিন, মোসাদ্দেক, মাহমুদউল্লাহ প্রত্যেকের দুঃসময়ে মাশরাফি তাঁদের পাশে ছিলেন। অধিনায়ক হিসেবে খেলা শেষে ম্যাচে মাশরাফি তাঁর উদারতা ও বড় মনের পরিচয় দিয়েছেন। কারণ, মাশরাফি সংবাদ সম্মেলনে দুজন কোচের নাম বলেছেন—জেমি সিডন্স ও হাথুরেসিংহের। সিডন্সকে কৃতিত্ব দিয়েছেন সাকিব, মুশফিক, তামিমের মতো খেলোয়াড় তৈরি করার জন্য, আর হাথুরেসিংহকে স্মরণ করছেন বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ভালো অবস্থানের জন্য। কিন্তু বিষয় হলো অধিনায়ক জীবনে এই দুই ভালো কোচের সঙ্গে তাঁর বনিবনা ভালো ছিল না। এটিও তাঁর উদারতার পরিচায়ক।

মাশরাফির বিদায়ী ম্যাচে তাঁর দায়িত্ববোধ বা জবাবদিহির কোনো ঘাটতি ছিল না। ফিল্ডিং সাজানো, বোলিং করানো, খেলোয়াড়কে উৎসাহ দেওয়া, নিজে ফিল্ডিং গুরুত্বসহকারে করা এবং ব্যাটিংয়ে খেলোয়াড় বাছাই করা এসব কাজে তাঁর সিদ্ধান্তগুলো যথার্থ এবং ধারাবাহিক জয়ের কারণ ছিল।

মাশরাফি বিন মুর্তজা
মাশরাফি বিন মুর্তজা

বাংলাদেশ ক্রিকেটে মি. ফ্যান্টাস্টিক অনুপ্রেরণার নাম
মাশরাফি ক্রিকেট খেলার যে অনুভূতির কথা বলেছিলেন, তা হলো দায়িত্ব ও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। সব সফলতা ও গুণাবলির কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে। প্রেজেন্টেশনের সময় ১৪ জন খেলোয়াড়কে থ্যাংক ইউ ক্যাপ্টেন ও মাশরাফির ছবিসংবলিত ২ নম্বর জার্সি পরিধান করে মাঠে আসার ব্যবস্থা করা। এটি হলো এক অনন্য উদাহরণ এবং এর মধ্য দিয়ে মাশরাফি যে অনুকরণীয় তা অন্য খেলোয়াড়দের বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে মি. ফ্যান্টাস্টিক এক অনুপ্রেরণার নাম। সব খেলোয়াড় এটাই প্রমাণ করে দিয়েছেন মাশরাফিকে আমরা ভুলতে চাই না, ভুলব না। বিসিবির পক্ষ থেকে ক্রেস্ট উপহার দেওয়া এবং ২ নম্বর জার্সি স্মারক হিসেবে মাশরাফিকে প্রদান করা হয়।

বিসিবি সঠিক ও সম্মান দেখানোর যথার্থ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করছি। বাংলাদেশের ক্রিকেটে কী না দিয়েছেন মাশরাফি, পারফরম্যান্স বা নেতৃত্ব দিয়ে নিজেকে নিয়েছিলেন অনেক উচ্চতায়। গ্যালারিতে ‘ভালোবাসি অধিনায়ক’ ফেস্টুন এবং দর্শকের জার্সিতে মাশরাফির স্মরণে লেখা শব্দগুলো এটা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে দর্শক বা আমরা তাকে কত ভালোবাসি বা পছন্দ করি। লিটনের ১৭৬ ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ স্কোর, তামিম বা লিটন দাসের ২৯২ রানের জুটি, সিরিজে বাংলাওয়াশ এবং আরও অন্যান্য রেকর্ড, যা অধিনায়কের বিদায়ী ম্যাচে ঘটেছিল। এগুলো তাঁর অধিনায়ক হিসেবে বিদায়ী ম্যাচে বিশাল অর্জন। সারা বাংলার মানুষ ৬ মার্চে অনুষ্ঠিত টেলিভিশনে চোখ রেখেছিল প্রিয় মাশরাফির অধিনায়ক হিসেবে শেষ ম্যাচ খেলা উপভোগের জন্য। কজন অধিনায়কের ভাগ্যে মেলে এ রকম নায়কোচিত বা বীরের সম্মান।

মাশরাফি নির্লোভ ও নির্মোহ। কারণ, জাতীয় সংসদের এমপি হয়েও লাল পাসপোর্ট, বাড়ি ও গাড়ি কিছুই নেননি। এমনকি নিজেকে এমপি পরিচয়ে অহংকার করার কোনো অনুভূতির চিহ্নও প্রকাশ করেননি। এ রকম উদাহরণসহ কজন জনপ্রতিনিধি বাংলাদেশে আছেন। তাই সব খেলোয়াড় বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে মাশরাফিকে অনুকরণ করে তাঁদের জীবনে বাস্তবায়ন করা উচিত।

দেশকে যা দিয়েছেন
আমি নিজেও আবেগতাড়িত হয়েছি সাকিব আল হাসান ও অন্য সিনিয়র খেলোয়াড়দের মাশরাফিকে নিয়ে করা মন্তব্য সামাজিক মাধ্যমে পড়ার সময়। অধিনায়ক হিসেবে সাফল্যের পরিসংখ্যান বলছি, ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল, ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল, ২০১৫ সালে পাকিস্তান, ভারত এবং দক্ষিণ অফ্রিকার বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজ জয়, ২০১৮ সালের এশিয়া কাপের ফাইনাল, চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সরাসরি খেলার যোগ্যতা এবং জয়ের শতকরা হিসাবে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সফল অধিনায়কের তালিকায় ১ নম্বর অবস্থান ইত্যাদি মাশরাফির ধারাবাহিক সফলতা।

ওয়ানডেতে জয়ের হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ডটিও বাংলাদেশ দল তাঁর নেতৃত্বে অর্জন করে। ১২৩ রানের বিশাল ব্যবধানে জয়, ওপেনিং পার্টনারশিপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জুটি, ৩-০ তে সিরিজ জয়, অধিনায়ক হিসেবে ৫০তম জয়, সবই হলো মাশরাফির বিদায়ী উপহার। তাই মি. ফ্যান্টাস্টিকের বিদায়ী মুহূর্ত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা দিয়ে সমাপ্ত হয়েছে। আমি বলব ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ও ব্যতিক্রমী অধিনায়ক মি. ফ্যান্টাস্টিক। সর্বোপরি অন্য সব খোলোয়াড়, তাঁর মতো দায়িত্ববোধ, কর্তব্যপরায়ণতা, সঠিক নেতৃত্ব এবং টিম স্পিরিট দিয়ে বাংলাদেশ দলকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এগিয়ে নিয়ে যাক, এটাই আমাদের কামনা ও প্রত্যাশা।

* লেখক: পিএইচডি ফেলো, জংনান ইউনিভার্সিটি অব ইকোনমিকস অ্যান্ড ল, চীন এবং সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়