দখলে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের স্বাক্ষর বিআইডব্লিউটিএর প্রতিবাদপত্রে

‘সীমানাখুঁটিতে “বৈধতা” পাচ্ছে দখল’ শিরোনামে ১৩ জুন প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ পাঠিয়েছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠানো প্রতিবাদপত্রটি (পিডিএফ ফরম্যাটে) ১৭ জুন বেলা ২টা ৪৮ মিনিটে পেয়েছে প্রথম আলো। প্রতিবাদপত্রের নিচের অংশে বিআইডব্লিউটিএর দুই কর্মকর্তার পাশাপাশি সরকারের জরিপে নদীর জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ করা প্রতিষ্ঠান মাইশা গ্রুপের নাম এবং একজনের সই রয়েছে। তবে ওই সইয়ের নিচে কারও নাম-পদবি উল্লেখ করা হয়নি।

প্রতিবাদপত্রে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক কাজী ওয়াকিল নওয়াজ এবং উপপরিচালক (বন্দর) মো. আজমল হুদা মিঠু সরকারের নাম, পদবি ও সই রয়েছে।

সরকারি সংস্থার পাঠানো প্রতিবাদপত্রের বক্তব্যের নিচের অংশে নদীর জায়গা দখলে অভিযুক্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নাম ও সই কীভাবে থাকে, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন নদী দখল-দূষণ রোধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, মাইশা গ্রুপ নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর টালবাহানা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। নদীর জায়গা উদ্ধারে আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে দেশে দুর্বলতা রয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএ, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, ঢাকা জেলা প্রশাসনসহ সরকারের আটটি সংস্থা যৌথ জরিপ করে বলেছিল, বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ ও জলাশয়ের ৫৪ একরের বেশি জায়গা দখল করে অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে মাইশা গ্রুপের মালিকানাধীন ‘আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন’ ও ‘মাইশা গ্রুপের পাওয়ার প্ল্যান্ট’। গত বছরের নভেম্বরে জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করে এসব স্থাপনা উচ্ছেদের সুপারিশ করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু (বছিলা সেতু নামে পরিচিত) পার হলেই ডান পাশে নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ওই দুটি স্থাপনা।

উল্লেখ্য, মাইশা গ্রুপের চেয়ারম্যান আসলামুল হক সম্প্রতি মারা গেছেন। তিনি ঢাকা-১৪ আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ ছিলেন। তিনি বেঁচে থাকতে নদীর জায়গা চেষ্টা করেও উদ্ধার করতে পারেনি বিআইডব্লিউটিএ। উল্টো তাঁর দখল করা জায়গায় নদীর সীমানা চিহ্নিত করতে গিয়ে কয়েক দফা বাধার মুখে পড়তে হয় বিআইডব্লিউটিএকে। নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আসলামুল হকের দখল করা জায়গার মধ্যে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগতীর এবং বন্দরের সীমার জমি প্রায় ৮ একর, নদীর জমি প্রায় ১৩ একর। বাকি জমি ড্যাপের আওতাভুক্ত।

সম্প্রতি সেখানে এককভাবে সীমানাখুঁটি বসানোর কাজ শুরু করেছে বিআইডব্লিউটিএ। দখলকৃত জায়গা বাদ দিয়েই বিআইডব্লিউটিএ সেখানে সীমানাখুঁটি বসাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ১৩ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদনে মূলত নদী রক্ষা কমিশনের সুপারিশ এবং বর্তমান বাস্তবতা—এই দুটো বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। নদী রক্ষা কমিশনকে না জানিয়ে সীমানাখুঁটি স্থাপনের বিষয়টি এতে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের বক্তব্যও ছাপা হয়েছে।

প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, ‘বিশেষ একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রসংলগ্ন সীমানা পিলার নিয়ে প্রতিবেদনটি প্রচারিত হওয়ায় বিআইডব্লিউটিএর তথা সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।’ প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনের কোন অংশ নিয়ে আপত্তি, তা উল্লেখ করেনি বিআইডব্লিউটিএ। প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, বর্তমানে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীরভূমিতে সিএস লাইনের ওপর ‘কান্ট্রি সাইড’-এ ‘ফোরশোর লাইন’ বরাবর সীমানা পিলার স্থাপন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বছিলা ব্রিজসংলগ্ন মাইশা পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আরিশা ইকোনমিক জোন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এলাকায়ও এর ব্যতিক্রম কিছু হচ্ছে না।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদারের বক্তব্যও ছাপা হয়েছিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, এককভাবে বিআইডব্লিউটিএ সেখানে নদীর সীমানাখুঁটি বসাতে পারে না। এখানে কোনো যোগসাজশ আছে বলে মনে হয়। অথবা তারা প্রভাবিত হয়েছে।

উল্লেখ্য, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের নির্দেশনায় নদী রক্ষা কমিশন দেশের সব নদ-নদীর আইনগত অভিভাবক।

দখলে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের স্বাক্ষরসহ বিআইডব্লিউটিএর প্রতিবাদপত্র পাঠানোর বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, কোনো সরকারি সংস্থার প্রতিবাদপত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার সই থাকা অগ্রহণযোগ্য। এটি কোনোভাবেই হতে পারে না।