দুপুরের পর যাত্রীর চাপ, বাড়তি ভাড়ার অভিযোগ

নৌপথে বাড়ি যেতে হাজারো মানুষের ভিড়। গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে
ছবি: দীপু মালাকার

সরকারি অফিসগুলোতে গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল ঈদের আগের শেষ কর্মদিবস। আজ শুক্রবার ও কাল শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। ফলে ঈদের ছুটির সঙ্গে সাপ্তাহিক ছুটি মিলে যাওয়ায় অনেকেই গতকাল ঢাকা ছাড়তে শুরু করেন।

তবে গতকাল দিনের প্রথম ভাগে কমলাপুর রেলস্টেশন ঘরমুখী মানুষের ভিড় ততটা ছিল না। দুপুরের পরই যাত্রীর চাপ বাড়তে থাকে। গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনালগুলোয় একই চিত্র দেখা যায়। সদরঘাটেও যাত্রীর চাপ ছিল কম।

দেরিতে ছেড়েছে চার ট্রেন

অগ্রিম টিকিট বিক্রি ধরলে রেলপথে ঈদযাত্রা শুরু হয়েছে বুধবার। গতকাল সকালের দিকে ভিড় কম ছিল কমলাপুর রেলস্টেশনে। দুপুর থেকে ভিড় বাড়তে শুরু করে, বিকেলে তা আরও বাড়ে। ভিড় সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও চারটি ট্রেন দেরিতে ছাড়ায় এসব ট্রেনযাত্রীকে দুর্ভোগে পড়তে হয়। অবশ্য এর মধ্যে একটি ট্রেন দেরিতে আসায় কর্তৃপক্ষ বিকল্প পথের আরেকটি ট্রেন দিয়ে নির্ধারিত সময়ে যাত্রার ব্যবস্থা করেছে।

কমলাপুর রেলস্টেশন কর্তৃপক্ষ জানায়, চিলাহাটিগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস, চট্টগ্রামগামী কর্ণফুলী কমিউটার ট্রেন এবং রাজশাহী কমিউটার দেড় থেকে দুই ঘণ্টা দেরিতে ছেড়ে গেছে। অন্য গন্তব্যের বিকল্প একটি ট্রেনে করে রংপুর এক্সপ্রেসের যাত্রীদের পাঠানো হয়েছে।

কর্ণফুলী ও নীলসাগর ট্রেন দুই ঘণ্টার বেশি দেরি হওয়ায় ট্রেনের ভেতরে ভ্যাপসা গরমে সবচেয়ে ভোগান্তিতে পড়েন নারী, বৃদ্ধ ও শিশুরা। সকাল ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে কর্ণফুলী ট্রেনের যাত্রী সরোয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ট্রেন ৮টা ৪৫ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও এখনো পৌঁছায়নি। অনেক গরম পড়ছে। আমি সবকিছু মানিয়ে নিতে পারলেও আমার বয়স্ক মা, শিশু সন্তান রয়েছে, তাদের ভোগান্তি কে দেখবে।’

সিঙ্গেল লাইন হওয়ায় ট্রেন বিলম্বে আসছে জানিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আমিনুল হক বলেন, ঈদের সময় যাত্রীর চাপ বেশি থাকে। যাত্রীরা বিভিন্ন স্টেশনে নামেন। এসব স্টেশনে নামতে গিয়ে যেখানে দুই থেকে তিন মিনিট বিরতি থাকার কথা ছিল, সেখানে ৫ থেকে ১০ মিনিট বিরতি নিতে হয়। এ কারণেই মূলত ট্রেনগুলোর দেরি হয়। নির্ধারিত সময়ে ট্রেনগুলো যাতে স্টেশন ছেড়ে যায়, যাত্রীদের যাতে ভোগান্তি কম হয়, সে জন্য তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন।

বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ

সাভারের হেমায়েতপুরে থাকেন ট্রাকচালক মো. সাকিন আলী। বাড়ি রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভায়। পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে গ্রামের বাড়ি যাবেন। তবে বাসের অগ্রিম টিকিট কাটেননি তিনি। গতকাল সকালে হেমায়েতপুরের রাজশাহীগামী বাসের কাউন্টারগুলোতে টিকিটের খোঁজ করে পাননি। পরে বেলা দেড়টার দিকে আসেন রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালে।

গাবতলীতেও রাজশাহীগামী বাসের বেশ কয়েকটি কাউন্টারে ঘুরে টিকিট পাননি সাকিন। বেলা আড়াইটার দিকে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আরও কয়েকটি কাউন্টার বাকি আছে। খুঁজে দেখি টিকিট পাই কি না।’

দুপুরে গাবতলী বাস টার্মিনালে দেখা যায়, ন্যাশনাল পরিবহন, হানিফ পরিবহনসহ উত্তরাঞ্চলের বাসগুলোর টিকিট অগ্রিম বিক্রি হয়ে গেছে। যাত্রার আগে কোনো কোনো বাসে দু-একটি আসন ফাঁকা থাকলে সেগুলো বিক্রি হচ্ছে কিছুটা বাড়তি দামে। কাউন্টার ছাড়া কিছু বাস উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যে যাচ্ছে। সেগুলোতে টিকিটের দাম চাওয়া হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে অগ্রিম টিকিট না কাটায় উত্তরাঞ্চলের অনেক যাত্রীকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ করলেন মো. রিয়াজ নামের এক ব্যক্তি। তিনি মেহেরপুর যাবেন। রিয়াজ বলেন, শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টার থেকে তাঁর কাছ থেকে ১০০ টাকা বাড়তি নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারের কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘মেহেরপুরের ভাড়া ৫০০ টাকা। ঈদ উপলক্ষে তা করা হয়েছে ৭০০ টাকা। ঈদ বকশিশ হিসেবে কেউ ৫০-১০০ টাকা দিলে সেটা নিই, না দিলে নিই না।’

গাবতলী বাস টার্মিনালে দায়িত্বরত বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাউন্টার নেই, এমন কিছু বাস যাত্রী পরিবহন করছে, এ তথ্য আমাদের কাছে আছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাব।’

যাত্রীর চাপ নেই নৌপথে

গতকাল বেলা পৌনে তিনটার সময় সদরঘাটে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ লঞ্চের তৃতীয় শ্রেণি বা ডেকে খুব কমসংখ্যক যাত্রী এসেছেন। ঢাকা থেকে সরাসরি বরিশালগামী লঞ্চ পারাবত-১০–এর ডেকে এ সময় কোনো যাত্রী ছিল না। লঞ্চটি রাত ৯টায় সদরঘাট ছেড়ে যায়।

ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে ঝালকাঠিগামী ফারহান-৭ লঞ্চের ডেকে মোট ১৮ জন যাত্রী দেখা গেছে। একটি পরিবারের চারজন বসে ছিলেন এক পাশে। মা, দুই মেয়ে ও দাদি। বেলা দুইটার সময় এসে পুরো ডেক খালি পেয়েছেন বলে জানান তাঁদের একজন। কেবিনের দায়িত্বে থাকা মো. রায়হান বলেন, কেবিনের কিছু যাত্রী এসেছেন। তবে এখনো চাপ শুরু হয়নি।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার পরিচালক মামুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন নৌপথের জন্য অতিরিক্ত লঞ্চ প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। যাত্রীর চাপ হলে প্রয়োজনে বিশেষ লঞ্চ পরিচালনা করবেন মালিকেরা। তবে আজ শুক্রবার বিশেষ ঈদ সার্ভিস থাকবে কি না, তা নির্ভর করবে যাত্রীর চাপের ওপর।

গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত বিভিন্ন গন্তব্যে ১০৩টি লঞ্চ সদরঘাট ছেড়ে গেছে বলে জানান সদরঘাটের বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক সেলিম রেজা।

ঘাটে ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ

মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাটে গতকাল সকাল থেকে ব্যক্তিগতসহ ছোট গাড়ির চাপ ছিল বেশি।

পরিবার নিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িতে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাচ্ছিলেন ব্যবসায়ী আকরাম হোসেন। তিনি বলেন, সকাল সাতটার দিকে ঘাটের এক কিলোমিটার দূরে নালী সড়কের কে এন আলী সেতুর কাছে এসে অন্যান্য গাড়ির সারিতে আটকা পড়েন। দুই ঘণ্টা পর ফেরির টিকিট পান।

সকাল থেকে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া এবং মাদারীপুরে বাংলাবাজার ও শরীয়তপুরের জাজিরা (সাত্তার মাদবর–মাঝিকান্দি) নৌপথে যাত্রীদের চাপ কিছুটা কম ছিল। তবে বিকেল থেকে যাত্রী ও যানবাহনের চাপ বাড়তে শুরু করে।

বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) ফয়সাল আহম্মেদ রাত আটটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ঘাটে ছোট, বড় ও মাঝারি আকারের ১০টি ফেরিতে যাত্রী ও যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। ঘাটে যানবাহনের চাপ বাড়ছে। শতাধিক গাড়ি পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে। রাত যত বাড়বে, চাপ তত বেশি বাড়তে থাকবে।

শিমুলিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া প্রতিটি স্পিডবোটে জনপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ করা দেওয়া ১৫০ টাকা। তবে স্পিডবোট ঘাটের ইজারায় থাকা ব্যক্তিরা জনপ্রতি ১৭০ টাকা ভাড়া নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নাজমুস সাকিব নামে বরিশালগামী এক যাত্রী বলেন, ‘সকাল থেকে শুনলাম ঘাটে চাপ কম। বিকেলে এসে দেখি স্পিডবোট ঘাটে যাত্রীদের ঢল নেমেছে। জোর করেই দেড় শ টাকার ভাড়া ১৭০ টাকা নিচ্ছে।’

মহাসড়কগুলোতে চাপ বেড়েছে

ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত অংশে গত দুপুরের পর থেকে গাড়ির চাপ বাড়তে থাকে। তবে সাড়ে রাত সাতটা পর্যন্ত কোথাও যানজট হয়নি। তবে যানবাহনের চাপে কিছুটা ধীরগতি দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু সেতু টোল প্লাজা সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার থেকে গত বুধবার রাত ১২টা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে ২৫ হাজার ৪৫০টি যানবাহন পারাপার হয়েছে।

সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম সংযোগ মহাসড়ক থেকে সিরাজগঞ্জ-বগুড়া মহাসড়কের চান্দাইকোনা পর্যন্ত যানবাহনের চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। তবে কোথাও যানজট দেখা যায়নি।

সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বলেন, ঈদযাত্রায় মহাসড়ক যানজটমুক্ত রাখতে ঝুঁকিপূর্ণ ৩০টি স্থানে পুলিশের অতিরিক্ত ২০০ সদস্য কাজ শুরু করেছেন। যানবাহনের চাপ একটু বেশি হলেও চলাচল এখনো স্বাভাবিক।

গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেও যানজট ছিল না। তবে তিনটার পর থেকে চিত্র পাল্টে যায়। যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ফলে থেমে থেমে সৃষ্টি হয় যানজটের। সন্ধ্যার পর পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই এলাকায় আটকে থাকে যানবাহন। ঘরমুখী মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গতকাল যাত্রীবাহী বাস চলাচল ছিল স্বাভাবিক। বেলা তিনটার পর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর সেতু থেকে মেঘনা সেতু পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কাঁচপুর বাসস্ট্যান্ড, মদনপুর, টিপুরদী, মোগরাপাড়া চৌরাস্তা ও মেঘনা সেতুর টোল প্লাজা এলাকায় মহাসড়কের দুই পাশে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়।

ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা কুমিল্লাগামী তিশা পরিবহনের চালক আরমান হোসেন জানান, কাঁচপুর সেতু পার হয়ে মেঘনা সেতুর টোল প্লাজা পর্যন্ত আসতে তার দেড় ঘণ্টা সময় লাগে, অন্য সময় ১৫ মিনিটে তিনি এ দূরত্বের জায়গা পার হতে পারেন।

হাইওয়ে পুলিশের কাঁচপুর থানার ওসি মো. নবীর হোসেন জানান, মহাসড়ক যানজটমুক্ত রাখতে পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মহাসড়কের দুই পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হলে যানজট আর থাকবে না।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, টাঙ্গাইল; প্রতিনিধি, গাজীপুর, শরীয়তপুর, সিরাজগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, সোনারগাঁ]