দুর্ঘটনার ৩৫% মোটরসাইকেলে

রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে সোমবার সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী স্বামী-স্ত্রী আকাশ ইকবাল ও মায়া হাজারিকা নিহত হয়েছেন। ভাগনে আকাশ ইকবালের মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মামা আসলাম হক ও মামি আজমেরি। গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে।ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসনকেন্দ্রের (পঙ্গু হাসপাতাল) অস্ত্রোপচারকক্ষের সামনের করিডরে গত শনিবার চিকিৎসাধীন ছিলেন ২৬ জন। প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, ১২ জনই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। অন্যদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সড়কে আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে যাওয়া ব্যক্তিদের বড় অংশই এখন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা গবেষকেরা বলেছেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো মূলত ঘটে বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, বারবার লেন পরিবর্তন, ট্রাফিক আইন না মানা ও চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোনে কথা বলার কারণে। হেলমেট ব্যবহার না করা ও নিম্নমানের হেলমেটের কারণে দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।

মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতির কারণে পথচারীদেরও দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হয়। তেমনই একজন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলম। গত শনিবার সন্ধ্যায় তিনি জাতীয় সংসদ ভবনের পাশের ক্রিসেন্ট লেক এলাকায় হাঁটতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাস্তা পার হওয়ার সময় তাঁকে একটি বেপরোয়া মোটরসাইকেল ধাক্কা দেয়। এ ঘটনায় তাঁর ডান পা ভেঙেছে।

সরেজমিন পঙ্গু হাসপাতাল

হাড়ভাঙা চিকিৎসায় দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান পঙ্গু হাসপাতাল। এর পুরো নাম জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)। হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত শনিবার বেলা একটা পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ৩৪ জন চিকিৎসা নেন। তাঁদের ১৬ জনই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। কেউ চালক, কেউ আরোহী এবং কেউ পথচারী।

জরুরি বিভাগের পাঁচটি নিবন্ধন বই ঘেঁটে জানা গেল, নতুন বছরের প্রথম ১৬ দিনে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ২ হাজার ৪৮২ জন। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ৫৮৫ জন। তাঁদের কতজন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত, তা উল্লেখ নেই। তবে নিটোরের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল গণি মোল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, নিটোরে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে যাওয়া প্রায় ৩৫ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। তিনি বলেন, রাজধানীর বাইরে থেকে রোগী বেশি আসে। সম্প্রতি শরিকি যাত্রা বা রাইড শেয়ারিংয়ে থাকা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত মানুষ আসার সংখ্যাও বাড়ছে।

হাত ভেঙে নিটোরে রোববার চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাইমুল ইসলাম। এই তরুণ অকপটে স্বীকার করেন, শনিবার রাতে বন্ধুর সঙ্গে দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গতি বেশি ছিল। তবে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি রাস্তায় বালুর কারণে।

বেপরোয়া চালনা নিয়ে সাধারণ মোটরসাইকেলচালকেরাও চিন্তিত। অফিস থেকে রাতে বনানী থেকে মিরপুরের বাসায় ফেরেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. নাঈম হাসান। তিনি বলেন, মোটরসাইকেল ও গাড়ি গতির প্রতিযোগিতায় নামে। সাধারণ মোটরসাইকেলচালকদের জন্য এটি বড় একটি ভয়ের কারণ।

কত যান, কত দুর্ঘটনা

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩১ লাখের বেশি, যা মোট যানবাহনের ৬৮ শতাংশ। শুধু ঢাকাতেই নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ৮ লাখের মতো। এর বাইরে একটি বড় অংশের মোটরসাইকেল অনিবন্ধিত। বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় ৫ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার খবর সংকলন করে বুয়েটের এআরআই ও নিসচা। নিসচার হিসাবে, ২০২০ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ২৩২টি, যার ১ হাজার ১২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এর মধ্যে ২৯ শতাংশ ট্রাক ও ২২ শতাংশ বাস দুর্ঘটনার। বুয়েটের এআরআইয়ের হিসাবে, ২০১৬ সালে ২৮৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩৩৬ জন মারা যান। ২০২০ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৮টিতে, মারা যান ১ হাজার ৯৭ জন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০০৬ সালের একটি গবেষণা বলছে, ভালো মানের একটি হেলমেট পরলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হওয়ার ঝুঁকি কমে ৭০ শতাংশ। আর মৃত্যুঝুঁকি কমে ৪০ শতাংশ। বড় শহরের বাইরে হেলমেট না পরার প্রবণতার বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া ও জনসংযোগ) মো. সোহেল রানা বলেন, হেল‌মেট না পরার কার‌ণে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হ‌চ্ছে। পাশাপা‌শি নানা স‌চেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া হ‌চ্ছে।

রাজধানীর বাইরে থেকে রোগী বেশি আসে। সম্প্রতি শরিকি যাত্রা বা রাইড শেয়ারিংয়ে থাকা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত মানুষ আসার সংখ্যাও বাড়ছে।
অধ্যাপক আবদুল গণি মোল্লাহ, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) পরিচালক

শরিকি যাত্রা বেড়েছে

ঢাকায় কয়েক বছরে মোটরসাইকেল রাইড শেয়ারিং ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এ খাতের কোম্পানিগুলোর নিবন্ধনের বাইরে অনেকে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন করেন।

বুয়েটের এআরআই ২০২০ সালে রাইড শেয়ারিংয়ের ৪৫০ মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহীর ওপর একটি জরিপ করে। এতে উঠে আসে, ৫০ শতাংশ আরোহী চালকের চালানো নিয়ে অনিরাপত্তায় ভোগেন। একই সংস্থার করা আরেক জরিপে এসেছে, চালকের ৩০ শতাংশ অতি নিম্নমানের হেলমেট পরেন। মাত্র ২ শতাংশ ক্ষেত্রে আরোহীদের ‘ফুলফেস’ হেলমেট দেওয়া হয়। এআরআইয়ের পর্যবেক্ষণ বলছে, রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলের চালকদের প্রতিযোগিতা ও ফাঁক গলে আগে যাওয়ার প্রবণতা দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ।

রাইড শেয়ারিং অ্যাপের বাহনগুলোর দুর্ঘটনার সংখ্যা কত, তা জানতে তিনটি রাইড শেয়ারিং অ্যাপ কর্তৃপক্ষের কাছে গত রোববার ই-মেইল পাঠায় প্রথম আলো। উবার দুর্ঘটনার সংখ্যা না জানালেও প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। তারা বলেছে, দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও স্থায়ী পঙ্গুত্বের জন্য ২ লাখ টাকা ও হাসপাতালে ভর্তি হলে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা বিমা–সুবিধা দেওয়া হয়। উবার জানিয়েছে, তারা সেরা মানের হেলমেট ব্যবহারে উৎসাহ দেয়।

পাঠাও ই-মেইলের উত্তর দেয়নি। তবে সহজ ডটকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা মালেক কাদির মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, রাইড শেয়ারিং অ্যাপে ব্যবহার করা চালকদের দুর্ঘটনা ঘটেছে, এমন তথ্য তাঁদের কাছে নেই।

চালক ও বিপণনকারী কী বলছেন

মোটরসাইকেল বিপণনকারী একটি বহুজাতিক কোম্পানির পর্যালোচনায় উঠে এসেছে যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার বড় কারণগুলোর একটি হলো ওভারটেকিং। এ ছাড়া ক্লান্তি নিয়ে চালানো এবং তাড়াহুড়া করাও অন্যতম কারণ। বাস, ট্রাক, লেগুনা ও প্রাইভেট কারের বেপরোয়া চালনা ও হঠাৎ লেন পরিবর্তন, অযান্ত্রিক যানবাহনের হুটহাট মোড় ঘোরানো ও লেন পরিবর্তন, রাস্তায় হঠাৎ গর্ত, ম্যানহোলের উঁচু অথবা নিচু ঢাকনা ও গতিরোধকে চিহ্ন না থাকা, পথচারীদের অসতর্কতা এবং হঠাৎ করে কুকুর, গরু-ছাগল রাস্তায় চলে আসাও দুর্ঘটনার বড় কারণ। যেমন রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে গতকাল আজমেরী পরিবহনের একটি বাসের চাপায় নিহত হন আকাশ ইকবাল (২৮) এবং তাঁর স্ত্রী মায়া হাজারিকা (২৫)।

বাবা আবদুল্লাহ আল মাসুমের সঙ্গে একমাত্র সন্তান মিথিলার এই ছবি এখন শুধুই স্মৃতি। চুয়াডাঙ্গায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় সোমবার সন্ধ্যায় শিশুটি হারিয়েছে মা-বাবা দুজনকেই।
ছবি: সংগৃহীত

দুটি কোম্পানির শীর্ষস্থানীয় দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যক্তিগত বাহন হিসেবে মোটরসাইকেলের বিক্রি বাড়ে। ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও ভারতের মতো বাংলাদেশেও মোটরসাইকেল বিক্রি বাড়বে। দুর্ঘটনা কমাতে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। তাঁরা আরও বলেন, দেশে মোটরসাইকেলের চালকদের প্রশিক্ষণের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি খাতকে সঙ্গে নিয়ে সচেতনতা ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। নিরাপত্তাব্যবস্থাযুক্ত উন্নত প্রযুক্তির মোটরসাইকেল কিনতে উৎসাহ দিতে হবে।

হোন্ডা বাংলাদেশ লিমিডেটের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা শাহ মোহাম্মদ আশিকুর রহমান বলেন, জাপানে একসময় দুর্ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল। পরে তারা নানা ব্যবস্থা নিয়ে তা কমিয়ে ফেলে। তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশে হোন্ডা প্রশিক্ষণ দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে লাইসেন্স দেয়। বাংলাদেশেও তাঁরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।

হেলমেটের নামে প্লাস্টিকের বাটি!

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরিচালক (মান) সাজ্জাদুল বারি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বিএসটিআইয়ে হেলমেটের মান পরীক্ষা করার সুবিধা আপাতত নেই।
যদিও বাজারে বিক্রি হওয়া সব হেলমেট বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মান অনুযায়ী উৎপাদন ও আমদানি হওয়ার কথা। বিএসটিআইয়ের নজরদারি না থাকায় বাজারে হেলমেটের বদলে বিক্রি হওয়া একাংশ মূলত প্লাস্টিকের বাটি।

সার্বিক বিষয়ে বুয়েটের এআরআইয়ের পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, চালক ও আরোহীর ভালো মানের হেলমেট পরা, রাইড শেয়ারিংয়ে চালকদের প্রতিযোগিতা কমানো, সচেতনতা বাড়ানো এবং ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগই সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কমাতে পারে।