দুর্যোগ-সহনীয় নির্মাণে জনসম্পৃক্ততা জরুরি

প্রথম আলো ও ক্রাউন সিমেন্ট আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক আলী আহম্মদ খান। পাশে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক খুরশীদ জাবিন হোসেন l ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো ও ক্রাউন সিমেন্ট আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক আলী আহম্মদ খান। পাশে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক খুরশীদ জাবিন হোসেন l ছবি: প্রথম আলো

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপদ ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করতে নির্মাণ-সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিমালাগুলো বাস্তবায়ন করা জরুরি। নির্মাণকাজে ব্যবহৃত উপকরণগুলোর গুণগত মানও নিশ্চিত করতে হবে। এর পাশাপাশি তাঁরা দুর্যোগ-সহনীয় নির্মাণ নিশ্চিত করতে জনগণকে সচেতন করার পরামর্শ দিয়েছেন।

গতকাল রোববার প্রথম আলো ও ক্রাউন সিমেন্ট আয়োজিত ‘দুর্যোগ রোধকল্পে মানসম্পন্ন নির্মাণ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

বৈঠকে বক্তারা মানসম্পন্ন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে কীভাবে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ রোধ করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করেন। পাশাপাশি তাঁরা বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধ করা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু ‘দুর্যোগ সহনীয়’ করা যায়।

দুর্যোগ-সংশ্লিষ্ট যেকোনো পরিকল্পনায় জনগণের সংশ্লিষ্টতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক খুরশীদ জাবিন হোসেন। তিনি বলেন, দুর্যোগ প্রতিরোধের উপায় আছে, কিন্তু সে উপায় বের করার মানসিকতা নেই। কোনো এলাকার সমস্যা ওই এলাকার লোকজন খুব ভালো বোঝেন, তাই দুর্যোগ মোকাবিলার যেকোনো পরিকল্পনা প্রণয়নে জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাঁদের পরামর্শ আস্থায় নিতে হবে।

খুরশীদ জাবিন বলেন, সরকার, প্রশাসন ও বিশেষজ্ঞরা আধুনিক প্রযুক্তি-সহায়তা দেবেন। তাহলেই সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব। তিনি নির্মাণ-সংক্রান্ত পরিকল্পনার বইগুলো বাংলা ভাষায় রূপান্তর করার পরামর্শ দেন, যেন সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারেন।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক আলী আহম্মদ খান বলেন, প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ দুর্যোগের ঝুঁকির মাত্রা কমিয়ে আনতে পারে। বিল্ডিং কোড খুবই ভালো, কিন্তু সেটির কার্যকর প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন নেই। দুর্যোগ-বিষয়ক কাজে সমন্বয়ের অভাব আছে। রাজউক, সিটি করপোরেশন, দুর্যোগ মন্ত্রণালয় ও ফায়ার সার্ভিসের মধ্যে সমন্বয় আরও বাড়াতে হবে।

অনিয়ন্ত্রিত অবকাঠামোর কারণে দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয় বলে মন্তব্য করে আহম্মদ খান বলেন, সরকারি-বেসরকারি অনেক ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা আছে। এগুলোকে রেট্রোফিটিং বা ভূমিকম্প-সহনশীল করা যেতে পারে। তিনি ঝুঁকিপূর্ণ গার্মেন্টস ভবনগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে রেট্রোফিটিং করার পরামর্শ দেন।

উপকূলীয় এলাকায় টেকসই আবাসনের ব্যবস্থা করতে সরকার কাজ করছে বলে জানান পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (জলবায়ু পরিবর্তন) শওকাত আলী মির্জা। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে উপকূলের লোকজন এখন দুর্যোগের ঝুঁকিতে বেশি আছে। উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের আঘাত সহনশীল কিংবা নোনা পানিতে ক্ষয় হবে না এমন আবাসন ব্যবস্থা তৈরি করতে ইতিমধ্যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে জরুরি ভিত্তিতে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসার দাবি জানান বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস হবে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের প্রধান স্তম্ভ। বর্তমানে দেশে ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রী আন্তর্জাতিক মানের। এর সুফল পেতে হলে নকশাকারী, প্রকৌশলীসহ সবার সমন্বয় জরুরি।

গোলটেবিল বৈঠকের সূচনায় মূল আলোচ্যসূচির ওপর আলোকপাত করে ক্রাউন সিমেন্টের উপদেষ্টা প্রকৌশলী এ মজিদ চৌধুরী বলেন, দুর্যোগ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ায়। প্রাকৃতিক, মানবসৃষ্ট দুর্যোগ কত কম দুর্ভোগ দেয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন মানসম্পন্ন নির্মাণ। নির্মাণকাজে যে উপকরণ ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর গুণগত মান নিশ্চিত করতে জোর দিতে হবে।

ঢাকা শহরে কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি ছাড়াই প্রচুর ভবন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) প্রিন্সিপাল রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার মো. আব্দুল ওয়াহেদ। তিনি বলেন, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নজরদারি খুবই জরুরি। নতুন ভবন নির্মাণের আগে মালিকদের সচেতন করতে নিরাপদ নির্মাণ বিষয়ে এইচবিআরআই সংক্ষিপ্ত একটি প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কোন এলাকায় কোন ধরনের বাড়ি নির্মাণ করা হবে, সে বিষয়ে একটি নীতিমালা করার চেষ্টাও করা হচ্ছে।

শেল্‌টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌফিক এম সেরাজ বলেন, যে কেউ ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। এটা হতে পারে না। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ ও মানের ভিত্তিতে এদের বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা উচিত। ব্যক্তি পর্যায়ে নকশা মেনে বাড়ি তৈরিতে উৎসাহিত করতে এলাকাভিত্তিক কিছু নির্দিষ্ট নকশা করা যেতে পারে।

জিপিএইচ ইস্পাতের নির্বাহী পরিচালক মাদানী এম ইমতিয়াজ হোসেন বলেন, মানবসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলায় যেভাবে কাজ করা দরকার, সেভাবে হচ্ছে না। বেসরকারি উদ্যোগে ঢাকার বাইরে উঁচু ভবন হচ্ছে, কিন্তু সেগুলোর মান নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির সাবেক মহাসচিব আলী আকবর মল্লিক বলেন, ভবন নির্মাণের আগে মাটি পরীক্ষা, ব্যবহৃত কংক্রিটের সক্ষমতা পরীক্ষা করতে খরচ খুব বেশি পড়ে না। কিন্তু এসব পরীক্ষা করানোর পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। এসব পরীক্ষা করানোর জন্য বেসরকারি খাতেও ব্যবস্থা থাকা দরকার।

দেশের ৮০-৯০ শতাংশ বাড়িই প্রকৌশলীদের পরামর্শ ও তত্ত্বাবধান ছাড়া নির্মিত হয় বলে মন্তব্য করেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল মালেক সিকদার। তিনি বলেন, বিদ্যমান আইন ও বিধিগুলো বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজও শুরু করা যায়নি। এসব নীতিমালা বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম বলেন, গ্রামাঞ্চলে এখন পাকা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। এসব বাড়ি করার আগে মাটি ও কংক্রিটের সক্ষমতা যাচাইয়ের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন তিনি।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক রাকিব আহসান বলেন, একটি স্থাপনা নির্মাণের পর সেটির রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টিও জরুরি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা উপেক্ষা করা হয়। এতে স্থাপনা দুর্বল হয়ে যাওয়ায় সেটি দুর্যোগ সহনশীল থাকে না। তিনি পরিকল্পনায় নির্মাণ-পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টিও যুক্ত করার পরামর্শ দেন।

ভবন নির্মাণে নীতিমালা মানা হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করতে কর্তৃপক্ষগুলো ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক আকতার মাহমুদ। তিনি বলেন, দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসে নগর পরিকল্পনা, ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, আইন বাস্তবায়নের মতো বিষয়গুলোতে জোর দিতে হবে। নির্মাণশ্রমিক এবং নির্মাণকাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।