‘দেশের যে অবস্থা তাতে কিছু বলতেও ভয় হয়’

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীতে ১৫ অক্টোবর (শুক্রবার) জুমার পর বিক্ষোভ মিছিল থেকে হামলা-ভাঙচুর চলাকালে দুটি ব্যক্তিগত গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, মণ্ডপ ও বসতবাড়িতে হামলা–অগ্নিসংযোগের প্রেক্ষাপটে দেশে কথা বলার স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ঝুমন দাশ। সুনামগঞ্জের শাল্লার এই যুবকও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার।

ছয় মাস কারাভোগের পর গত মাসে মুক্তি পান ঝুমন দাশ
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

হেফাজতে ইসলামের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মামুনুল হককে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে গত মার্চে ঝুমন দাশ ও তাঁর প্রতিবেশীদের বাড়িতে হামলা হয়েছিল। হামলা যাতে না হয় সেজন্য নিজ সম্প্রদায়ের লোকেরাই ঝুমস দাসকে পুলিশে দিয়েছিল। তারপরও ওই হামলা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ছয় মাসের বেশি কারাভোগ করে গত মাসে ছাড়া পান ঝুমন দাশ।

আজ শনিবার এক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে ঝুমন দাশ বলেন, ‘দেশের যে অবস্থা তাতে কিছু বলতেও ভয় হয়। স্বাধীনভাবে বাঁচার অবস্থা সংখ্যালঘুদের জন্য নেই।’

মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিত ‘সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি ও বিচারহীনতা’ শিরোনামের এই ওয়েবিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও নারীপক্ষের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শিরিন হকসহ কয়েকজন বক্তব্য দেন। তাঁদের মতে, দুর্গাপূজার সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও মণ্ডপে হামলার ঘটনা শুধু সাম্প্রদায়িক হামলা নয়, এর পেছনে রাজনীতি আছে, বিচারহীনতা আছে। এবার শুধু রাষ্ট্র নয়, সমাজও ব্যর্থ হয়েছে। এখন সংখ্যালঘুদের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি।

আসিফ নজরুল বলেন, কুমিল্লার ঘটনায় ইকবাল নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইকবাল প্রকৃত অপরাধী নাকি জজ মিয়া তা তিনি নিশ্চিত নন। তিনি বলেন, ৮ থেকে ১০ দিন ধরে বিভিন্ন জায়গায় হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, সাম্প্রদায়িক সহিংহতার ঘটনা যদি তিন দিনের বেশি সময় ধরে ঘটে, তাহলে তার পেছনে সরকারের কোনো না কোনো প্রশ্রয় থাকে। সরকারের প্রশ্রয় ছাড়া এ রকম চলতে পারে না। রাষ্ট্রের সব শক্তি যেন পীরগঞ্জের ঘটনার মতো একটি ঘটনার অপেক্ষায় ছিল। তিনি বলেন, বিভিন্ন জায়গায় হামলাকারীরা ছিল বহিরাগত।

সাম্প্রদায়িক আক্রমণের এই ধারা প্রতিবেশী একটি দেশের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। এটি শুধু সাম্প্রদায়িক হামলা নয়, এর পেছনে রাজনীতি আছে, বিচারহীনতা আছে।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল
ফাইল ছবি

আসিফ নজরুল আরও বলেন, একটি ধারণা প্রচলিত আছে, দেশের একটি রাজনৈতিক দলের নীতি সাম্প্রদায়িক। এটি পুরোপুরি ভুল। এখন উপলব্ধি করা প্রয়োজন একটি দলের নীতি সাম্প্রদায়িকতা, আরেকটি দলের পুঁজি সাম্প্রদায়িকতা। একটি দল নির্বাচনে হেরে গেলে বা জয়ী হলে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ করে। এখন কোনো নির্বাচন নেই। এই হামলায় তারা কতটুকু জড়িত তা নিয়ে সন্দেহ আছে। যারা সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে তাদের পক্ষে সব সময় আক্রমণ করা সম্ভব। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তা ‘সেল’ করতে সুবিধা হয়।

আসিফ নজরুল বলেন, বিভিন্ন জায়গায় হামলার সময় পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল।

নোয়াখালীতে তিন ঘণ্টা ভাংচুরের পর পুলিশ এসেছে। এর আগে যেসব হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে, কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি।

হামলার পর নোয়াখালীর বিভিন্ন মন্দির ও মণ্ডপ পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন রোবায়েত ফেরদৌস। তিনি বলেন, নোয়াখালীতে না গেলে সেখানে কী হয়েছে, তার একশ ভাগের এক ভাগও বোঝা যাবে না। এবার কেবল রাষ্ট্র বা আইন নয়, সমাজই ব্যর্থ হয়েছে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, প্রতিবেশী কেউ সংখ্যালঘুদের রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। বেগমগঞ্জের সাংসদ ঘটনাস্থলে যাননি। এখন রাষ্ট্রের সঙ্গে সমাজও সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছে মন্তব্য করে রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, দেশে বছরের পর বছর ধরে সাম্প্রদায়িকতার চাষ হচ্ছে। এখন প্রতিবাদ দিয়ে হবে না, প্রতিরোধ করতে হবে।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক শিরিন হক বলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় পুলিশ প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। ঘটনার পর মন্ত্রীরাও ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাননি। প্রধানমন্ত্রী যদি আক্রান্তদের কাছে যেতেন, তাহলে তাঁরা আস্থা পেতেন। এখন মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। সাম্প্রদায়িক হামলার কোনো ঘটনার বিচার হয় না। একটা ঘটনার যদি বিচার হতো, তাহলে তারা ভয় পেত। এখন মনে করে কিছুই হবে না।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, তাঁরা সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদ করছেন, কিন্তু কোনো সমাধান দেখতে পাচ্ছেন না। ঘটনার এতদিন পার হয়ে গেলেও সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান, বিরোধী দলের প্রধান, পুলিশের প্রধান কেউ কোনো ঘটনাস্থলে যাননি। তাঁরা কেন গেলেন না, এটা একটা বড় প্রশ্ন।