দেশে ৩২ লাখ টিকা দেওয়া হবে শনিবার

করোনাভাইরাসের টিকা
প্রতীকী ছবি

দেশে আগামী শনিবার থেকে শুরু হচ্ছে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত সপ্তাহব্যাপী করোনার টিকাদান কর্মসূচি। প্রথম দিন প্রায় ৩২ লাখ টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে সরকার।

টিকা দিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আবার কোন পর্যায়ে কয়টি করে টিকাকেন্দ্র হবে, কোথায় টিকাকেন্দ্রগুলো করা হবে, তা-ও ঠিক হয়েছে। এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ে ইতিমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে গতকাল বুধবার বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত অনলাইনে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রতিটি জেলার জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন, পুলিশ সুপার (এসপি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অংশ নেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, প্রতিটি ইউনিয়নে সপ্তাহে দুদিন নিয়মিত টিকাদান ঠিক রাখা হবে। এর বাইরে তিন দিন করোনার টিকা দেওয়া হবে।

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সদস্যসচিব ডা. মো. শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, একেক দিন প্রায় ৩২ লাখ ৩০ হাজার ৬০০ জনকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। কর্মসূচির প্রথম দিন এ রকম পরিমাণ টিকাই দেওয়া হবে। সারা দেশে ৮১ হাজার ১৬৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী এ কাজে নিয়োজিত থাকবেন।

কয়েক দিন ধরে দিনে তিন লাখের মতো করোনার টিকা দেওয়া হচ্ছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা দিতে কেন্দ্র থাকবে প্রায় ১৪ হাজার।

এর আগে ১ আগস্ট স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এক অনুষ্ঠানে জানান, ৭ থেকে ১৪ আগস্টের মধ্যে সরকার এক কোটি টিকা দিতে চায়। সরকারের হাতে এখন প্রায় সোয়া কোটি টিকা আছে। আরও এক কোটির মতো টিকা এ মাসের মধ্যেই আসবে।

বাংলাদেশে প্রথম করোনার টিকা আসে গত ২১ জানুয়ারি। এরপর গত ৭ ফেব্রুয়ারি গণটিকাদান শুরু হয়। ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় দেশের টিকা কার্যক্রম গতি হারিয়েছিল। তবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান থেকে টিকা আসায় এ কার্যক্রম আবার গতি পেয়েছে। এ পর্যন্ত ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপান মিলিয়ে মোট টিকা এসেছে ২ কোটি ৫৬ লাখ ৪৩ হাজার ৯২০টি। এ পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৯ হাজার ৯৫৩ জনকে। আর দুই ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে ৪৪ লাখ ১৬ হাজার ১৩১ জনকে। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এতে প্রয়োজন হবে প্রায় ২৬ কোটি টিকা।

দেশে করোনা পরিস্থিতি ১৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায়। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে চলছে বিধিনিষেধ। তবে সরকার মাস্ক পরা ও টিকাদানে গুরুত্ব দিয়ে ১১ আগস্ট থেকে বিধিনিষেধ শিথিল করতে চায়। খুলে দিতে চায় গণপরিবহন, অফিস, আদালত ও বিপণিবিতান। এমন সময়েই শুরু হচ্ছে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদান।

কোথায় কত কেন্দ্র

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি ইউনিয়নে দিনে তিনটি ওয়ার্ডের জন্য একটি করে টিকাকেন্দ্র পরিচালনা করা হবে। সেখানে তিনটি বুথ থাকবে। পৌরসভার ক্ষেত্রে প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে টিকাকেন্দ্র থাকবে।

এর আগে গত ২৮ জুলাই সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির পক্ষ থেকে টিকাদান কার্যক্রম বাস্তবায়ন পরিকল্পনার নির্দেশনা দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একটি চিঠি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, টিকাদানকেন্দ্রে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত টিকা দেওয়া হবে। শেষ টিকা দেওয়ার পর টিকাদান দল এক ঘণ্টা কেন্দ্রে অবস্থান করবে। ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সীদের টিকা দেওয়া হবে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত বয়োজ্যেষ্ঠ ও নারীদের টিকা দেওয়া হবে। এর পরে এলেও তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

টিকা দেওয়ার আগে গ্রহীতাদের তথ্য লিপিবদ্ধ করা হবে। নিবন্ধনের পর গ্রহীতাদের টিকা কার্ড দেওয়া হবে। এই কার্ড দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার দিন অবশ্যই সঙ্গে আনতে হবে। টিকাকর্মীরা টিকাদানের পর অনলাইন নিবন্ধনসহ টিকার তথ্য লিপিবদ্ধ করবেন। সব তথ্য দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার আগেই হালনাগাদ করতে হবে।

পঞ্চগড়ের সিভিল সার্জন ডা. ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শুরুতে তিন দিন কার্যক্রম চালানোর কথা বলা হয়েছিল। এখন কোথাও এক দিন এবং পর্যাপ্ত টিকা থাকলে দুই দিন কার্যক্রম চালানো হবে।

মাঠপর্যায়ে প্রস্তুতি

টিকা দিতে প্রস্তুতি কেমন, তা জানতে গতকাল প্রথম আলোর পক্ষ থেকে জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়। কারও কারও প্রস্তুতি শেষ। কেউ কেউ আজ বৃহস্পতিবার ও আগামীকাল শুক্রবারের মধ্যে প্রস্তুতি শেষ করার লক্ষ্যে কাজ করছেন।

শেরপুর জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডের ২০০ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। প্রথম দিন জেলায় কমপক্ষে ৩৬ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়া হবে।

ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদান শুরু হচ্ছে বর্ষাকালে। এ সময়ে মানুষ টিকাকেন্দ্রে উৎসাহ নিয়ে যাবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা আছে বলে মনে করেন কোনো কোনো জনস্বাস্থ্যবিদ। গণটিকাদান সপ্তাহ সফল করতে প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে গতকাল প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ১০টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, টিকা দেওয়ার বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা তাঁরা পেয়েছেন। স্থানীয় পর্যায়ে সভাও হয়েছে।

পাবনার ঈশ্বরদীর পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. এনামুল হক বিশ্বাস বলেন, তাঁর ইউনিয়নে তিন দিন (৭, ৯ ও ১০ আগস্ট) টিকা দেওয়া হবে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, এখন যাঁরা নিবন্ধন করবেন, কেবল তাঁদের এ টিকা দেওয়া হবে। এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে আজ (বৃহস্পতিবার) মাইকিং করা হবে।

শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, তাঁদের উপজেলায় দুদিনে এই টিকা দেওয়া হবে।

পোশাকশ্রমিকদের টিকা

রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের শ্রমিকদের করোনার টিকা দেওয়ার প্রাথমিক প্রক্রিয়া হিসেবে তালিকা সংগ্রহ শুরু হয়েছে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কবে থেকে শ্রমিকদের টিকা দেওয়া শুরু হবে, সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। পোশাক খাতে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পর নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ ও বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ তাদের সদস্য কারখানাগুলোকে শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কাছে পাঠাতে বলেছে। অন্যদিকে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা জানান, শ্রমিক-কর্মচারীর তালিকা সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে পাঠাতে খুদে বার্তা (এসএমএস) দেওয়া হয়েছে।

বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএর নেতারা জানান, সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে কারখানায় কারখানায় গিয়ে শ্রমিকদের টিকা দেওয়া হবে। এ জন্য কারখানায় নিয়োজিত চিকিৎসক-নার্স সহযোগিতা করবেন।

বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘গাজীপুরের সিভিল সার্জন আমাদের জানিয়েছেন, ১১ আগস্টের পর টিকা দেওয়া শুরু হবে। টিকা দিতে আমাদের কারখানার চিকিৎসক ও নার্সের সহযোগিতা থাকবে।’

দোকানমালিকদের টিকা দিতে চিঠি

এদিকে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি বিশেষ ব্যবস্থায় ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীদের টিকা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীদের টিকা দেওয়ার বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। এ জন্য তাঁরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গতকাল একটি চিঠি দিয়েছেন। এতে ১০ আগস্টের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ লাখ ব্যবসায়ী-দোকানকর্মীকে টিকা দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।

করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে গত মঙ্গলবার সরকারের আন্তমন্ত্রণালয় সভায় ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে টিকাদান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, টিকাদানে বয়স্ক মানুষকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষ বা দোকানদার, বাসের কর্মীদের নিজ নিজ ওয়ার্ড থেকে টিকা নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।