দোষারোপ চলছে, দাম কমছে না

চালের দাম ২০২০ সাল থেকেই চড়া। ২০১৯ সালে সরু চালের গড় দর ছিল ৪৮ টাকা কেজি, এখন বাজারে ৬৬ থেকে ৮০ টাকা।

টিপু মুনশি, বাণিজ্যমন্ত্রী

বোরোর ভরা মৌসুমে বাজারে চালের দাম কেন বাড়ল, তা নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ চলছে। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার কয়েক দিন ধরেই বড় কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে বক্তব্য দিচ্ছেন। গতকাল বৃহস্পতিবারও তিনি একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।

দেশের অন্যতম চাল সরবরাহকারী জেলা কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসনের সঙ্গে এক বৈঠকে গতকাল চালকলমালিকেরাও চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান, ছোট চালকল ও ধানের আড়তমালিকদের দায়ী করেছেন। ওদিকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তারা চালের বাজারে খুব নগণ্য হিস্যাধারী। বড় হিস্যা মূলত বড় চালকলগুলোর। তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।

আরও পড়ুন

এই দোষারোপের মধ্যে বাজারে অভিযানও চলছে। গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া এ অভিযানে জরিমানা করা হচ্ছে, ধান-চাল জব্দ করা হচ্ছে। কেনাবেচার হিসাব তদারকি শুরু করেছে প্রশাসন। কিন্তু দাম তেমন একটা কমছে না।

রাজধানীর চালের পাইকারি বাজার মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট এবং খুচরা বাজার হাতিরপুল, নিউমার্কেট ও মোহাম্মদপুর টাউন হল ঘুরে দেখা যায়, বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে চাল। খুচরা বাজারে সরু মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল ৬৬ থেকে ৮০ টাকা, মাঝারি চাল ৫৫ থেকে ৫৮ এবং মোটা চাল মানভেদে ৪৮ থেকে ৫৩ টাকা দরে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, দুই সপ্তাহে চালের দাম কেজিতে ৩ থেকে ৭ টাকা বেড়েছে।

বড় গ্রুপগুলো চাল কিনে প্যাকেট করছে। উদাহরণস্বরূপ যে চালটা বাজারে ৫০ টাকা, সেটি শুধু প্যাকেট করে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি করছে। নিশ্চয়ই তারা গ্রাহক পাচ্ছে বলেই বিক্রি করতে পারছে।
টিপু মুনশি, বাণিজ্যমন্ত্রী
সাধন চন্দ্র মজুমদার, খাদ্যমন্ত্রী

কুষ্টিয়ার খাজানগরের চালকল পর্যায়ে চালের দাম কমেনি। অবশ্য নওগাঁয় ধানের দাম কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার আড়তমালিকেরা।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চলমান মজুতদারিবিরোধী অভিযানের সুফল পেতে শুরু করেছি। এ অভিযান আরও চলবে। বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য আসছে যে পাইকারি পর্যায়ে চালের দাম কমতে শুরু করেছে। বাজারে এর প্রভাব পড়তে কিছুটা সময় লাগবে।’

দোষারোপ

চাল সংগ্রহ নিয়ে এক অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে খাদ্যমন্ত্রী গতকাল অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান ধান-চাল সংগ্রহ করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব মিল না থাকলে তারা যেন এ ব্যবসায় যুক্ত না হতে পারে, সেটি নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এর আগের দুদিন খাদ্যমন্ত্রী প্যাকেটজাত করে বড় করপোরেটরা যে চাল বিক্রি করছে, তা বন্ধ করার কথাও বলেন।

এদিকে গতকাল সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, দেশের চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইউরোপের সমপর্যায়ের। তিনি আরও বলেন, বড় গ্রুপগুলো চাল কিনে প্যাকেট করছে। উদাহরণস্বরূপ যে চালটা বাজারে ৫০ টাকা, সেটি শুধু প্যাকেট করে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি করছে। নিশ্চয়ই তারা গ্রাহক পাচ্ছে বলেই বিক্রি করতে পারছে।

এদিকে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে গতকাল ফ্রেশ অ্যাগ্রো ফুড নামের একটি চালকলের মালিক ওমর ফারুক ৩৮টি অটোরাইস মিলকে দায়ী করে বলেন, এরা নিজেরা কোনো চাল উৎপাদন করে না। বাইরের বিভিন্ন চাল কিনে বস্তায় ভরে বেশি দামে বিক্রি করে।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিলমালিক সমিতি কুষ্টিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন প্রধান দায়ী করেন ধানের আড়তদারদের। তিনি বলেন, ধান কৃষক ও মিলারদের কাছে নেই; যা মজুত আছে, সব আড়তদারদের কাছে।

দুই ঘণ্টার বৈঠকে চালের দাম কমবে কি না, সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান ধান–চাল সংগ্রহ করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব মিল না থাকলে তারা যেন এ ব্যবসায় যুক্ত না হতে পারে, সেটি নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সাধন চন্দ্র মজুমদার, খাদ্যমন্ত্রী
বেশি দামে চাল বিক্রি ঠেকাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ সময় এক বিক্রেতাকে জরিমানা করলে তিনি হাতজোড় করে ক্ষমা চান। গতকাল রাজধানীর বাদামতলীতে
ছবি : সাজিদ হোসেন

দাম আগে থেকেই বেশি

এখন দোষারোপ চললেও দেশে চালের দাম ২০২০ সাল থেকেই চড়া। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৯ সালে মোটা চালের জাতীয় গড় দর কেজিতে ৩০ টাকা ও সরু চাল ৪৮ টাকা ছিল। দাম ২০২০ সালের মার্চ থেকে বাড়তে থাকে। এখন দর অনেক বেশি।

বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশে চালের চাহিদা ও উৎপাদনের হিসাব নিয়ে প্রশ্ন আছে। যেমন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ২০২০ সালে জানিয়েছিল, বছরের শেষ নাগাদ ৫৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। কিন্তু দেখা গেল, এত উদ্বৃত্তের পরও চালের দাম বাড়ছেই। গত দুই বছরে চালের দাম কমাতে মিলপর্যায়ে মূল্য বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, তাতে কাজ হয়নি। শর্তযুক্ত আমদানিতে সুফল পাওয়া যায়নি। এবার তিন দিন ধরে বাজারে পুরোনো কৌশলে অভিযান চলছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, চালের বাজার নিয়ে একের পর এক খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। সরবরাহ কমে যায়, এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে অতীতে এসব বিষয় নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদেরসহ চালকলমালিকদের নিয়ে বসে প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

এবার ‘ভিন্ন’ পরিস্থিতি

দেশে বছরে সাড়ে তিন কোটি টনের মতো চাল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে দুই কোটি টন হয় বোরো মৌসুমে। প্রতিবছর বোরো মৌসুমে চালের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমে। এ বছর দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র।

এ বছর বোরো মৌসুমের শুরুতেই হাওরের কিছু ফসল তলিয়ে যায়। এ ছাড়া টানা বৃষ্টির কারণে পাকা ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মোট কত ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব তৈরি করছে সরকার। ওদিকে চালের বিকল্প গমের দাম বিশ্ববাজারে বেড়ে গেছে। ভারত গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে।

সরকারের মজুত অবশ্য গত বছরের চেয়ে বেশি। এখন সরকারের গুদামে ১১ লাখ টনের বেশি চাল আছে।

চাল আমদানিতে এখন মোট করভার ৬৩ শতাংশ। ফলে আমদানি হচ্ছে না। দেশি চাল ব্যবসায়ীদের কোনো প্রতিযোগী নেই। তাঁরা বড় মুনাফার সম্ভাবনা দেখছেন বলেই চালের বাজারে বিনিয়োগ করছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান প্রথম আলোকে বলেন, সংকটের সময় সবাই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। অভিযান চালিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কী কারণে এ সংকট তৈরি হলো, সেটা বিশ্লেষণ করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তিনি বলেন, এখন বাজার নিয়ন্ত্রণে চালের শুল্ক কমিয়ে আমদানি উন্মুক্ত করা যেতে পারে। শুল্কহার এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে বাজারে দামটি যৌক্তিক পর্যায়ে নামে, কিন্তু কৃষকের জন্য ধানের ভালো দরও নিশ্চিত হয়।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, কুষ্টিয়া প্রতিনিধি, নওগাঁ]