দ্বিগুণ মুনাফার ফাঁদে ২ লাখ গ্রাহক

আমানত রাখলে সুদ পাওয়া যায় সাড়ে ১০ শতাংশ হারে। এই লোভ দেখিয়ে দুই লাখের বেশি মানুষের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছে দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড।

নামের শেষে ব্যাংক ব্যবহার করা হলেও এটি একটি সমবায় সমিতি। সমিতিটি থেকে ঋণও পাওয়া যায় দিনে দিনেই।

অবৈধভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানো এই দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভে বর্তমানে আমানতের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, অতিমুনাফার লোভে আমানতের অতিরিক্ত সুদ দিতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ফলে দুই লাখের বেশি গ্রাহকের প্রায় এক হাজার কোটি টাকা আমানতের অর্থ চাহিবামাত্র ফেরত দেওয়ার বিষয়টি ঝুঁকিগ্রস্ত হয়ে উঠছে।

পরিস্থিতি আওতার বাইরে চলে যেতে থাকায় ঢাকা জেলা সমবায় কার্যালয় গতকাল রোববার প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন করে আমানত সংগ্রহ, ঋণ বিতরণ ও শেয়ার বিক্রি না করার নির্দেশ দিয়েছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটিতে প্রশাসক পদমর্যাদার প্রধান নির্বাহী নিয়োগের জন্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। ঢাকা জেলা সমবায় অফিসার মুহামমাদ গালীব খান প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে গত ২৪ মে জেলা সমবায় কার্যালয় ‘ব্যাংক’ শব্দ ব্যবহার ও অবৈধভাবে লেনদেন বন্ধ করতে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতির কাছে একটি চিঠি পাঠায়। পাশাপাশি সমবায় সমিতি আইন অনুযায়ী নিবন্ধন কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে ১৫ দিনের সময় দেওয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও গত ১১ এপ্রিল এক চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়, সমবায় অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানটি কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিতরণ, স্থায়ী আমানত গ্রহণ এবং শরিয়া ব্যাংক তথা সামগ্রিকভাবে অবৈধ ব্যাংকিং করছে। প্রতিষ্ঠানটি জঙ্গি অর্থায়নের সঙ্গেও সম্পৃক্ত কি না, খতিয়ে দেখা দরকার।

আরও প্রায় এক বছর আগে, গত ১১ অক্টোবর অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকেও সমবায় কার্যালয়ে পাঠানো এক স্মারকে বলা হয়েছিল, প্রতিষ্ঠানটি অবৈধ ও অননুমোদিতভাবে সারা দেশে শাখা খুলে অবৈধভাবে ব্যাংকের মতো আমানত সংগ্রহ ও দাদন কার্যক্রম চালাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৮৩৬ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করলেও কোনো স্থাবর সম্পত্তি নেই। ফলে যেকোনো সময় ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউ, ম্যাক্সিম ও আইডিয়ালের মতো বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।

 গত বছরের জুন পর্যন্ত হিসাবে দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভের আমানতের পরিমাণ ছিল ৮৩৬ কোটি টাকা, ঋণ ৯৪৫ কোটি টাকা। আর অন্য ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৫১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে সিমতির আমানতকারীর সংখ্যা ২ লাখ ১৩ হাজার ৬১৭ জন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সুযোগ আছে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার। জনগণের আমানত তো এখানে জমা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক, সমবায় অধিদপ্তর মিলে সমন্বিত ব্যবস্থা নিলে সবার জন্য ভালো হয়। না হয় ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউর মতো অবস্থা হবে। লাখ লাখ গ্রাহক ক্ষতিতে পড়বে।

 সমবায় নিবন্ধিত ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভের ‘ব্যাংক’ শব্দ ব্যবহারে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলছে, প্রতিষ্ঠানটি সমবায় সমিতির আড়ালে সম্পূর্ণ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাহ্যিক অবয়ব ও নাম দেখে সাধারণ জনগণ সমিতিটিকে ব্যাংক মনে করছে। এতে বেশি মুনাফার আশায় আমানত রেখে নিরীহ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঋণ দিতেও আগ্রাসী আচরণ করছে প্রতিষ্ঠানটি। চাহিবামাত্র ঋণ দিচ্ছে।

যেমন, প্রিন্সিপাল শাখার গ্রাহক মো. রাজ্জাক ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর দুই কোটি টাকা ঋণের আবেদন করলে সেদিনেই ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। একইভাবে ফার্মগেট শাখার গ্রাহক ক্যাপ্রিকর্নস লিমিটেড ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই ঋণের আবেদন করলে ২১ জুলাই অনুমোদন হয়। ঋণ নিয়ে গ্রাহক প্রাইম ব্যাংক উত্তরা শাখার ঋণ পরিশোধ করেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবু জাফর চৌধুরী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুন্নাহার স্বামী-স্ত্রী। জনগণের বিপুল আমানত গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানটি একটি করপোরেট সুশাসনবিহীন পারিবারিক চক্রে আবদ্ধ। যা আমানতকারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

সমবায় অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আবু জাফর চৌধুরী, শামসুন্নাহারসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৩ সদস্যের বিরুদ্ধে ১০ কোটি ২৪ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে অধিদপ্তর। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।

একই সঙ্গে আবু জাফর চৌধুরীর অবৈধ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়ায় জেলা সমবায় কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাঁর দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের অনুরোধ জানানো হয়েছে।

সামগ্রিক বিষয়ে দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির কেন্দ্রীয় বিনিয়োগ বিভাগের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মনিরুল ইসলাম গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমবায় অধিদপ্তরের কাছে দুই মাস সময় চেয়েছি। ১৯৭৩ সালে নামে ব্যাংক থাকলেও আমরা সমবায় অধিদপ্তরের অধীনে একটি সমিতি। একটু বেশি সুদে আমানত নিলেও এখানে গ্রাহকের আমানত নিরাপদ।’

ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ১৯৭৩ সালে বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সোসাইটি অ্যাক্ট, ১৯৪০-এর অধীনে অফিস অব দ্য রেজিস্ট্রার অব কো-অপারেটিভ সোসাইটি থেকে নিবন্ধিত হয়। সমবায় সমিতি আইন ২০০১-এর ৩৬ ধারা অনুযায়ী, কোনো সমবায় সমিতি সদস্যবহির্ভূত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত নিতে পারে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত ২০১৪-১৫ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির লভ্যাংশ ছিল ৫০ শতাংশ। তবে শেয়ারের লভ্যাংশের প্রকৃত সুবিধাভোগী কারা, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকেরা তাঁদের বিনিয়োগ করা মূলধনের ওপর ৩২২ শতাংশ মুনাফা দেখিয়ে অর্থ তুলে নিয়েছেন। তবে কারা প্রকৃত সুবিধাভোগী তা জানতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিদর্শন করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সহযোগিতা না করার কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

গতকাল রোববার প্রতিষ্ঠানটির মহাখালী, বাংলামোটর ও প্রিন্সিপাল শাখায় গিয়ে দেখা যায়, ব্যাংকের মতোই কার্যক্রম চলছে। ঋণ পেতে আবেদন করতে হয়। আমানত রাখতে হলে একটি সদস্য ফরম পূরণ করতে হয়। শাখায় রয়েছে অর্থ জমা ও গ্রহণের জন্য পৃথক কাউন্টার।

চাইলেই আমানত ফেরত দিতে পারবেন কি না, এ প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানটির বাংলামোটর শাখার ব্যবস্থাপক রেজাউল ইসলাম খান বলেন, ‘অনেক ব্যাংক তো বন্ধ হয়ে গেছে, তারাই দিতে পারছে না। তবে আমরা গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারব। ১৯৭৩ সাল থেকে যেহেতু পারছি, এখনো পারব।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এ প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি নির্দেশনা পেয়েছিলাম। আমরা গ্রাহকদের সতর্ক করেছি। আমাদের দুটি বিভাগ এ নিয়ে কাজ করছে। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।’