ধান আর আমে সমৃদ্ধ নওগাঁ

একসময় নওগাঁর উঁচু অঞ্চলগুলোতে বৃষ্টিনির্ভর আমন ধান ছাড়া অন্য কোনো ফসলের আবাদ হতো না। তবে এক দশক ধরে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষ হচ্ছে। বেশি লাভজনক হওয়ায় কৃষকেরা ধানি জমিতেও ফলের বাগান গড়ে তুলছেন।

ধান উৎপাদনে নিজেদের সমৃদ্ধির পাশাপাশি দেশকেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে ভূমিকা রাখছেন নওগাঁ জেলার কৃষকেরাছবি: প্রথম আলো

আবহাওয়া ও মাটি বেশি রুক্ষ হওয়ায় ঠা ঠা বরেন্দ্র ভূমি হিসেবে পরিচিত নওগাঁ জেলা। একসময় এ জেলায় বৃষ্টিনির্ভর আমন ধান ছাড়া তেমন কোনো ফসল হতো না। বছরে প্রায় সাত থেকে আট মাস এখানকার কৃষিজমি অনাবাদি পড়ে থাকত। তবে কৃষির আধুনিকায়নের ফলে বদলে গেছে সেই চিত্র।

জেলার অধিকাংশ জমিই এখন তিন ফসলে পরিণত হয়েছে। তবে ধান ও আম চাষে এখানকার কৃষক বেশি আগ্রহী। আর এই দুই ফসলে এখন ঘুরছে জেলার অর্থনীতির চাকা। ধান ও আমের পাশাপাশি দিন দিন মাছ চাষেরও পরিধি বাড়ছে জেলায়।

নব্বইয়ের দশকে নওগাঁয় গভীর নলকূপ প্রকল্পের সেচব্যবস্থা চালু করে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। এর আগে যে জমিতে ১০ থেকে ১২ মণ ধান উৎপাদিত হতো, এখন সেই জমিতেই ২৫ থেকে ৩০ মণ পর্যন্ত ধান উৎপাদন হচ্ছে। ধান চাষ ছাড়াও এক দশক ধরে নওগাঁর কৃষি অর্থনীতিতে অবদান রাখছে বাণিজ্যিকভাবে ফলের উৎপাদন। বিশেষ করে আম, পেয়ারা, বরই, লিচু ও ড্রাগন ফলের চাষ জেলার কৃষিকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নওগাঁ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ৩ হাজার ৪৩৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জেলায় ৫ লাখ ১৯ হাজার ২৫২টি কৃষক পরিবার। ভূমিহীন কৃষক পরিবারের সংখ্যা ২৮ হাজার ৭৩৫। বর্তমানে ফসলি জমির পরিমাণ ২ লাখ ৬৫ লাখ ৮৭৩ হেক্টর। এর মধ্যে আমসহ অন্যান্য ফলদ বাগান রয়েছে ৩৪ হাজার ৬২৬ হেক্টর জমিতে। বাকি জমিতে ধান, গম, আলুসহ অন্যান্য খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। চলতি আমন মৌসুমে ১ লাখ ৯৭ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে ধানের চাষ হয়েছে। এই মৌসুমে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬৩৪ মেট্রিক টন। গত বোরো মৌসুমে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৪২ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছিল। আরেক প্রধান ফসল আম চাষের জমির পরিমাণ বর্তমানে ২৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর। চলতি অর্থবছরে আম উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, পোরশা, সাপাহার ও নিয়ামতপুর উপজেলার কিছু কিছু উঁচু অঞ্চল ছাড়া জেলার ৮০ শতাংশ জমিই সমতল। মাটির গুণাগুণ ভালো হওয়ায় এবং সমতল এলাকায় গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচব্যবস্থা থাকায় সব ধরনের ফসল আবাদের উপযোগী। একসময় উঁচু অঞ্চলগুলোতে বৃষ্টিনির্ভর আমন ধান ছাড়া অন্য কোনো ফসল আবাদ হতো না। তবে এক দশক ধরে ওই সব অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষ হচ্ছে। ধানের চেয়ে ফল চাষ অনেক বেশি লাভজনক হওয়ায় কৃষকেরা ধানি জমিতেও ফলের বাগান গড়ে তুলছেন।

আমের বাণিজ্যিক বাগান

নওগাঁর পোরশা, সাপাহার, পত্নীতলা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় ফসলি মাঠের দিকে তাকালে এখন আমের বাগান চোখে পড়ে। আম উৎপাদনে কোন জেলা সবার ওপরে, এ প্রশ্ন করা হলে সবার মাথায় প্রথমেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাম আসে। তবে সরকারি হিসাব অনুযায়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সেই একচ্ছত্র আধিপত্য আর নেই। এ বছর আম উৎপাদনে দ্বিতীয় হলেও গত বছর প্রথম ছিল নওগাঁ।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর নওগাঁয় ২৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। ২০১৫ সালে জেলায় আম চাষের জমির পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৯২৬ হেক্টরে। ২০১০ সালে এই পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ২৬৮ হেক্টর। অর্থাৎ গত এক দশকে নওগাঁয় ১৯ হাজার ৫৮২ হেক্টর জমিতে আম চাষের পরিধি বেড়েছে। বর্তমানে জেলায় আমবাগানের সংখ্যা ১০ হাজার ৫৮৬টি। আমচাষির সংখ্যা ৭ হাজার ৭৪৮ জন।

বর্তমানে নওগাঁয় সবচেয়ে বেশি আম চাষ হয় পোরশা উপজেলায়। এরপরেই রয়েছে সাপাহার। পোরশাতে আম চাষের জমির পরিমাণ ৯ হাজার ৮২৫ হেক্টর। এ উপজেলায় মোট কৃষিজমির পরিমাণ ২২ হাজার ৮৫০ হেক্টর। অর্থাৎ উপজেলার প্রায় অর্ধেক কৃষিজমিতেই আমবাগান গড়ে উঠেছে। সাপাহার উপজেলাতে আম চাষের জমির পরিমাণ ৭ হাজার ৯৮৭ হেক্টর।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নওগাঁ কার্যালয়ের উপপরিচালক শামসুল ওয়াদুদ বলেন, ধানের তুলনায় আম, পেয়ারাসহ অন্যান্য ফলদ বাগানে খরচ ও শ্রম দুটোই কম। সেই তুলনায় ধানের চেয়ে ফল চাষ অনেক বেশি লাভজনক। বর্তমান বাজার মূল্যে এক বিঘা জমিতে আম চাষ করে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব। ধান চাষে যে পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানির দরকার হয়, তার চার ভাগের এক ভাগই ফল চাষে প্রয়োজন হয় না। একটি এলাকায় বড় বড় গাছ থাকলে সেই এলাকায় প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ জন্য কৃষি বিভাগ বেশ কয়েক বছর ধরে ফলদ বাগান গড়ে তুলতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছে।

কৃষি উপকরণের ব্যবসা

ধানকে কেন্দ্র করে আশির দশক থেকে জেলায় চালকল কারখানা গড়ে উঠতে থাকে। পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। জেলায় চালকলের সংখ্যা বর্তমানে ১ হাজার ২৮৫। এসব কারখানায় ৬০ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করে তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করছেন। এর পাশাপাশি গড়ে উঠেছে গবাদিপশুর খাদ্য ও রাইস ব্রান অয়েল (চালের তেল) উৎপাদনকারী কারখানা। এ ছাড়া নওগাঁ বিসিক শিল্পনগরীতে বেশ কিছু ফুড ইন্ডাস্ট্রি, প্লাস্টিক ও চট কারখানা সাফল্য এনেছে। চালকল ও ফুড ইন্ডাস্ট্রি ছাড়াও এ জেলায় আরও বেশ কিছু কৃষিভিত্তিক শিল্প (দুধ ও পোলট্রি) গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ সম্পর্কে কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন বলেন, চলতি আমন মৌসুমে নওগাঁয় ৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশি চাল উৎপাদন হবে। এই এক মৌসুমেই ৪০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসার সম্ভাবনা আছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, ধান উৎপাদনে নিজেদের সমৃদ্ধির পাশাপাশি দেশকেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে ভূমিকা রাখছেন এ জেলার কৃষকেরা।