নতুন উদ্ভাবনকে উৎসাহ ও সমর্থন দিতে হবে

ড. তাহমিদ আহমেদ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পুষ্টিবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত। তিন দশকের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) গবেষণাকাজে যুক্ত। আইসিডিডিআরবির ৬০ বছরের ইতিহাসে তিনি প্রথম বাংলাদেশি, যিনি নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিশির মোড়ল

তাহমিদ আহমেদ

প্রশ্ন :

করোনা মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশ কেমন করল? কোন কোন ক্ষেত্রে ভালো করেছে, কোন কোন ক্ষেত্রে আরও ভালো করার সুযোগ ছিল?

তাহমিদ আহমেদ: ধনী বা দরিদ্র, ইউরোপ বা এশিয়ার বিশ্বের কোনো দেশেরই ৮-৯ মাস আগে কোভিড-১৯ সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। মহামারি মোকাবিলায় পদক্ষেপগুলো নিতে হয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে। বাংলাদেশ খারাপ করেনি। বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হবে, লাখের ওপর মৃত্যু হবে, হাসপাতালগুলো রোগীর চাপ সামলাতে পারবে না, রাস্তায় মৃত মানুষ পড়ে থাকবে—এমন কথাও আমরা শুনেছি। কিছু পূর্বাভাসও ছিল। এসব কথা ঠিক হয়নি। জনবহুল এই দেশে সংক্রমণ কম কেন, তা নিয়ে নিশ্চয়ই গবেষণা হবে। বিভিন্ন রোগজীবাণুর সংস্পর্শে আমাদের বসবাস সংক্রমণ কম হওয়ার একটি কারণ হতেও পারে। দেশব্যাপী লকডাউন করা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তা দেওয়াসহ সরকারি নানা পদক্ষেপ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বেশ কিছু সামাজিক উদ্যোগও ছিল। তবে এখন সংক্রমণ কম থাকার কারণে আত্মতুষ্টিতে ভোগার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। মানুষ মাস্ক পরছে না, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়গুলো গুরুত্ব হারিয়েছে। এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন আচরণে উদ্বুদ্ধ করার কাজে গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রশ্ন :

আমাদের সামনে এখন ঝুঁকিগুলো কী কী? তা মোকাবিলায় আমাদের কী করা উচিত?

তাহমিদ আহমেদ: সংক্রমণ এখনো নিয়ন্ত্রণে নেই এবং শীতে সংক্রমণ বাড়তে পারে এমন ঝুঁকির কথাও শোনা যাচ্ছে। ইউরোপে যেসব দেশ মৌলিক বিষয়গুলো যেমন মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে শিথিলতা দেখিয়েছে, সেসব দেশে আবার প্রবলভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ফিরে আসছে। সুতরাং সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধির মৌলিক বিষয়গুলোকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। পাড়ায়-মহল্লায় মুরব্বিদের বা যুবসমাজকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। শুনেছি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে করোনা স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করছেন। আমাদের দেশেও স্বেচ্ছাসেবী গড়ে তুলতে হবে।

বস্তি, চর, চা–বাগান বা এ ধরনের দুর্গম এলাকা, যেখানে পৌঁছানো কঠিন; সেখানকার মানুষের পুষ্টির কথা আলাদা করে ভাবতে হবে। প্রয়োজনে তাদের জন্য বিশেষ পুষ্টি প্যাকেজের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রশ্ন :

বলা হচ্ছে করোনা একেবারে বিদায় হবে না। সংক্রমণের ঝুঁকি তাই থেকেই যাবে। সে ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের পদক্ষেপগুলো কী হওয়া উচিত?

তাহমিদ আহমেদ: দীর্ঘ মেয়াদের প্রসঙ্গ যখন আসবে, তখনো মৌলিক বিষয়গুলো, যেমন মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি মেনে চলতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে নীতিনির্ধারণ ও পরিকল্পনায় টিকাকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, দেশে টিকার ট্রায়াল করতে হবে। ট্রায়াল করার মধ্য দিয়ে অনেক কিছু জানা-বোঝার সুযোগ সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত, দেশে টিকা উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো টিকা উৎপাদন করলে খরচ কম পড়বে। অন্যের ওপর নির্ভরতাও কমবে। অন্য একটি বিষয়ে কথা বলা জরুরি মনে করছি। দেশে এখন মানসম্পন্ন বিজ্ঞানী ও ল্যাবরেটরি আছে। টিকা উদ্ভাবনে দেশের বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালাচ্ছেন। নতুন উদ্ভাবনকে উৎসাহিত ও সমর্থন জানাতে হবে। এ ক্ষেত্রে গ্লোব বায়োটেকের নাম করা দরকার। তারা ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে।

প্রশ্ন :

করোনা, ইবোলা কিংবা এ ধরনের নতুন সংক্রমণে কোন ধরনের প্রস্তুতি দরকার? এ ক্ষেত্রে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কী ভূমিকা রাখতে পারে?

তাহমিদ আহমেদ: নিকট অতীতে বেশ কিছু রোগ প্রাণী থেকে মানুষে এসেছে। পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও বনরুই থেকে কোভিড-১৯ এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ জনবহুল দেশ, এ কথা ঠিক। তবে এ দেশের মানুষ বাছবিচারহীনভাবে পশু বা প্রাণীর সংস্পর্শে আসে না বা তাদের খাদ্য হিসেবে নেয় না। বাংলাদেশে ভাইরাসটি আমদানি হয়েছে। অন্য ভাইরাসগুলোর ক্ষেত্রেও তা–ই। এ ক্ষেত্রে রোগ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। জ্বরের ওপর যাঁরা নজরদারি করেন, তাঁরা হয়তো দেখলেন, হঠাৎ জ্বরের রোগী বেড়ে গেছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে তাঁরা হয়তো নতুন কিছু পেয়ে যাবেন। চীনে অজ্ঞাত কারণে নিউমোনিয়া রোগের বিষয়ে জানতে গিয়েই নতুন ভাইরাসের দেখা মেলে। সন্দেহভাজন চিহ্নিত করা, রোগ শনাক্ত করা, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করা, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন—এসব বিষয়ে জোর দিতে হবে। এসব বিষয়ে জনবল বাড়াতে হবে, তাঁদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রশ্ন :

চলমান মহামারি থেকে বিশ্ব বা বাংলাদেশ কী শিক্ষা নিল?

তাহমিদ আহমেদ: মানবজাতি নিজেকে অনেক বুদ্ধিমান, অনেক জ্ঞানী মনে করে আসছে। এই ভাইরাস মোকাবিলা করতে গিয়ে তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। মানুষের না–দেখা, না–জানা অনেক বিষয় রয়ে গেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতিতে মানুষ চরমে পৌঁছে গেছে, এটা মনে করার কারণ নেই। দ্বিতীয় শিক্ষা হচ্ছে, মহামারির মতো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রশিক্ষিত জনবল প্রস্তুত রাখা দরকার। প্রাথমিক ও দ্বিতীয় স্তরের হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে জনস্বাস্থ্য কর্মসূচিকে জোরদার করতে হবে। মহামারি মোকাবিলা করতে গিয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নানা ঘাটতি, কমতি দেখার সুযোগ হয়েছে। যেমন একটি সময় ভেন্টিলেটর নিয়ে কথা ওঠে। কিন্তু যন্ত্র থাকাই যথেষ্ট নয়। এই যন্ত্র সফলভাবে কাজে লাগাতে তিন–চার ধরনের প্রশিক্ষিত জনবল দরকার। অন্য শিক্ষা হচ্ছে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্​রোগ, ক্যানসারে ভোগা—অর্থাৎ অসংক্রামক রোগে ভোগা মানুষ তীব্রভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে কিছু রোগের সঙ্গে আবার পুষ্টির সম্পর্ক আছে।

প্রশ্ন :

আপনি দীর্ঘদিন পুষ্টি নিয়ে গবেষণা করছেন। এই মহামারি পুষ্টি পরিস্থিতির ওপর কী প্রভাব ফেলছে?

তাহমিদ আহমেদ: ইতিমধ্যে বৈশ্বিক পর্যায়ে তিনটি গবেষণা বা সমীক্ষার তথ্য আমরা পেয়েছি। তাতে দেখা যাচ্ছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে অপুষ্টি বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান ১৪১টি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে পর্যালোচনা করেছে। তাতে তারা দেখেছে, ২০২০ সালে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে গড় আয় ৮ শতাংশ কমেছে। ব্যষ্টিক অর্থনীতি বিশ্লেষণ করে অন্য সমীক্ষা বলছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে কৃশকায় শিশু ১৪ শতাংশ বেড়ে যাবে। আয় কমলে মানুষ পর্যাপ্ত খাবার কিংবা পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারে না। তৃতীয় গবেষণাটি বলছে, মহামারির কারণে নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা বা পুষ্টিসেবা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে ২০২০ সালে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে কৃশকায় ১ লাখ ২৮ হাজার শিশু মারা যেতে পারে।

আমি মনে করি, বাংলাদেশে কৃশকায় শিশু ১৪ শতাংশ বাড়বে না। ওই কারণে শিশুমৃত্যুও বাড়বে না। বাংলাদেশে মানুষ কাজে ফিরেছে, অর্থনীতি চালু আছে। দ্বিতীয়ত, মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় যুক্ত হয়েছে এমন অনেক উদাহরণ দেখা গেছে। বোরো ধানের ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় হাওর এলাকায়। লকডাউন চলার সময় হাওর এলাকায় পাকা ধান বন্যায় নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি দেখা গিয়েছিল। তখন অন্য জেলা থেকে মানুষ নিয়ে ধান কাটার উদ্যোগ নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়।

মহামারির মতো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রশিক্ষিত জনবল প্রস্তুত রাখা দরকার

প্রশ্ন :

পুষ্টি পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে কোন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার?

তাহমিদ আহমেদ: প্রত্যক্ষ পুষ্টি উদ্যোগ বাড়াতে হবে বা জোরদার করতে হবে। যেমন ভিটামিন এ কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে, আইওয়াইসিএফ (ইনফ্যান্ট অ্যান্ড ইয়াং চাইল্ড ফিডিং) বার্তা বারবার প্রচার করতে হবে। অন্যদিকে তীব্র অপুষ্টির শিকার শিশুদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বাড়ি পরিদর্শন করে আয়োডিন মেশানো লবণ বা পুষ্টিসমৃদ্ধ তেলের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী অনুপুষ্টি সরবরাহ করতে হবে। অন্যদিকে নিউট্রিশন সেনসেটিভ বা পুষ্টি সংবেদনশীল উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে। খাদ্যনিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হঠাৎ করে কোনো খাদ্যের দাম যেন বেড়ে না যায়। এ ব্যাপারে সরকারকে কঠোর হতে হবে। বস্তি, চর, চা–বাগান বা এ ধরনের দুর্গম এলাকা, যেখানে পৌঁছানো কঠিন; সেখানকার মানুষের পুষ্টির কথা আলাদা করে ভাবতে হবে। প্রয়োজনে তাদের জন্য বিশেষ পুষ্টি প্যাকেজের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের যেসব সামাজিক সহায়তা কর্মসূচি আছে, তা যেন সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, ঠিক মানুষ সহায়তা পায়, সে ব্যাপারে নজরদারি বাড়াতে হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

তাহমিদ আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।